মানুষ মারা এমন ভোট বন্ধ হোক, দাবি হিংসা-ধ্বস্ত ভাঙড়ের
West Bengal Panchayat Election 2023

ভাঙড় জুড়ে যেন শ্মশানের নিস্তব্ধতা!

দুপুরের পরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ভাঙড়ে পৌঁছলেও পুলিশ সবটা সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। বোমার পাশ দিয়েই চলেছে স্থানীয় মানুষের ঝুঁকির যাতায়াত। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছেন সে সবের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ভাঙড়  শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩ ০৮:২৮
Share:

শোকস্তব্ধ: নিহত হাসান আলি মোল্লার পরিবার। ছবি: সামসুল হুদা।

বাসন্তী হাইওয়ে ছেড়ে ঘটকপুকুর মোড় দিয়ে ঢুকলেই পরপর দোকানের শাটার নামানো। বেলা ১২টাতেও কোনও দোকানের তালা খোলেনি। ঘটকপুকুর, বিজয়গঞ্জ, সোনপুর বাজারের মতো জমজমাট এলাকা প্রায় জনশূন্য। সব সময়ে ভিড়ে ঠাসা শাসক দলের কার্যালয়েও তালা ঝুলছে। যেন অঘোষিত ‘বন্‌ধ’ চলছে! ফাঁকা রাস্তায় ঘুরছে শুধু পুলিশের গাড়ি। এ হেন থমথমে পরিস্থিতি আতঙ্কের চেহারা নেয় ভাঙড়ের ভোটগণনা কেন্দ্র কাঁঠালিয়া হাইস্কুলের দিকে এগোলেই। সেখানে রাস্তার দু’ধারে পুলিশের ভাঙা গাড়ি পর পর পড়ে আছে। ভাঙচুরের চিহ্ন স্পষ্ট নির্বাচনী আধিকারিকদের গাড়িতেও। এক-একটির এমনই অবস্থা যে, সামনের বা পিছনের অংশ বলতে কিছু অবশিষ্ট নেই। স্কুলের গেটের কাছে আবার ইটের টুকরোর ছড়াছড়ি। পড়ে আছে ভাঙা লাঠি, কাঠের টুকরো এবং ব্যবহার হওয়া গুলির খোল! তবে, এই সব কিছুকেই যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে গণনা কেন্দ্রের কাছে ইতিউতি পড়ে থাকা তাজা বোমা। অধিকাংশই নিষ্ক্রিয় করা হয়নি বিকেল পর্যন্ত।

Advertisement

দুপুরের পরে বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ভাঙড়ে পৌঁছলেও পুলিশ সবটা সরিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। বোমার পাশ দিয়েই চলেছে স্থানীয় মানুষের ঝুঁকির যাতায়াত। কেউ কেউ দাঁড়িয়ে ছবিও তুলেছেন সে সবের। কেউ কেউ আবার স্কুল চত্বরে আসছেন গত রাত থেকে নিখোঁজ পরিজনদের খোঁজে। কিন্তু পুলিশ সবেতেই যেন নীরব দর্শকের ভূমিকায়! বোমা পড়ে থাকা জায়গা ঘিরে দেওয়া তো দূর, কাউকে সেখান দিয়ে যেতে বারণও করা হচ্ছে না। মঙ্গলবার রাতের রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার ঘোর যেন কাটিয়ে উঠতে পারেনি তারা। ওই এলাকা দিয়েই কোনও মতে হেঁটে যাওয়া এক স্থানীয় বাসিন্দা বললেন, ‘‘এমন মানুষ মারা ভোট এ বার বন্ধ হোক। কবে শান্তি ফিরবে ভাঙড়ে, নেতারা এ বার সেই প্রশ্নের উত্তর দিন।’’

মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া ঘিরে বিস্তর গন্ডগোল দেখেছে ভাঙড়। সেই সময়ে তিন জনের মৃত্যুতে রাজ্য রাজনীতিতে শোরগোল পড়ে যায়। সেই থেকেই ভয়ে কুঁকড়ে থাকা ভাঙড়ে ভোটের দিনও বোমা পড়েছে, গুলি চলেছে। তবে নতুন করে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু মঙ্গলবার রাতে ভোটগণনাকে কেন্দ্র করে যা ঘটেছে, তা সাম্প্রতিক অতীতের সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়দের বড় অংশ। ওই ঘটনায় বুধবার রাত পর্যন্ত তিন জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে, রাতটুকু অপেক্ষার পরে এ দিন সকাল থেকেই ভাঙড়ের গ্রামের ভিতরে ঢুকে তল্লাশি শুরু করেছে পুলিশ। সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ২০০ জনকে আটক করার খবর মিলেছে। তবে, জয়পুর, শানপুকুর, কচুয়া, বেলেদোনার মতো বিভিন্ন এলাকায় গাছের গুঁড়ি ফেলে রাস্তা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। মৃত রেজাউল গাজির গ্রামে আবার মৃতদেহ নিয়ে রাস্তা অবরোধ করা হয়। পুলিশ গিয়ে বার বার বুঝিয়েও দেহ ময়না তদন্তে পাঠাতে পারেনি।

Advertisement

একই পরিস্থিতি হাসান আলি মোল্লার গ্রামেও। সেখানে পুলিশকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখানো হয়। হাসানের পরিবারের দাবি, ‘‘জেলা পরিষদের একটি আসনে জিতে যাওয়ার পরেও সার্টিফিকেট না দিয়ে ফের গণনা করা হয়েছে আরাবুল ইসলামের নির্দেশে। সেই সময়ে প্রতিবাদ করতে গেলে পুলিশের পোশাকে দুষ্কৃতীরা গুলি চালিয়েছে।’’ রেজাউলের দাদা মনিরুল গাজির দাবি, ‘‘ক্যানিং পূর্বের বিধায়ক শওকত মোল্লার ছেলেরাই পুলিশের পোশাক পরে গুলি চালিয়েছে। রেজাউলের স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। পুরো পরিবার ভেসে যাওয়ার মুখে!’’ শওকতের যদিও দাবি, ‘‘জোর করে জেলা পরিষদের দখল নিতে নওসাদ সিদ্দিকীর নির্দেশে ওই ভাবে হামলা চালিয়েছে আইএসএফ। পুলিশ কেন আরও আগে গুলি চালাল না?’’ ভাঙড়ের তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলামের আবার বক্তব্য, ‘‘আমাকে খুনের চক্রান্ত করা হয়েছিল। পুলিশ নিজের রক্ত দিয়ে কোনও মতে ঠেকিয়েছে।’’

গত কয়েক দিনের মতো এ দিনও ভাঙড়ে যাননি আইএসএফ চেয়ারম্যান তথা ভাঙড়ের বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকী। ফুরফুরা শরিফ থেকে এ দিনও তাঁর দাবি, ‘‘ফলাফল দেখেই আশঙ্কা করেছিলাম, ভাঙড়ে অশান্তি বাধানোর চেষ্টা হবে। প্রশাসন কিছুতেই ঠিকঠাক ভূমিকা পালন করছে না।’’ তবে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ধর্ষণের মামলায় এ দিন হাই কোর্ট জানিয়েছে, আগামী ১৮ জুলাই পর্যন্ত নওসাদের বিরুদ্ধে কোনও কড়া পদক্ষেপ করা যাবে না। ওই দিন মামলার পরবর্তী শুনানি। এটি ভাঙড়ের বিধায়কের জন্য রক্ষাকবচ বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে কি এ বার ভাঙড়ে যাবেন তিনি? নওসাদ বলেন, ‘‘দ্রুত ওখানকার মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে শান্তির আবেদন জানাব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন