বাঁ দিক থেকে, আকাশ মাইতি, সুমন পুরকাইত ও সন্দীপ ভৌমিক। নিজস্ব চিত্র।
পরিবারের আর্থিক সমস্যার সঙ্গে লড়াই করে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে ওরা। এ পর্যন্ত সব বাধা অতিক্রম করেছে। কিন্তু এ বার ভাল ফল করেও কী ভাবে পড়াশোনা চালাবে, তা নিয়ে সংশয়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার তিন কৃতী ছাত্র। কলেজ থেকে ফর্ম তোলা হয়ে গেলেও ভবিষ্যতে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন সমস্যা ওদের কাছে।
ফর্ম ডাউনলোড করার পরেও ব্যাঙ্কে মাত্র দেড়শো টাকা জমা করতে হিমসিম খাচ্ছে ফলতা ফতেপুর শ্রীনাথ ইন্সটিটিউশনের ছাত্র সন্দীপ ভৌমিক। রামেশ্বরবাটিতে বাড়ি ওই ছাত্রের। উচ্চমাধ্যমিকে ৭৭ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান অথবা ভূগোলে অনার্স নিয়ে পড়তে চায় সন্দীপ। কিন্তু কী ভাবে পড়াশোনা চালাবে তা এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। তার কথায়, ‘‘ফর্ম ডাউনলোড করেছি ঠিকই। কিন্তু আবার অনেক সময়ে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কথাও ভাবছি। কারণ প্রায় দেড় বছর বাবা কাজ করতে পারেন না। বাড়ির চার সদস্যের জন্য এ বার আমায় একটা কাজ জোগাড় করতেই হবে।’’ স্কুলের শিক্ষকেরা সকলেই সন্দীপকে সাহায্য করেছেন। প্রধান শিক্ষক অমলকান্তি ঘোষ বলেন, ‘‘উচ্চশিক্ষার খরচ টানতে না পারার জন্য যদি ওর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, তা হলে সেটা খুবই আক্ষেপের।’’ ঝালাই মিস্ত্রির কাজ করতেন সন্দীপের বাবা। শারীরিক অসুস্থতার কারণে এখন তা-ও পারেন না। সে কারণেই সন্দীপের দিদির মাঝপথে পড়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আত্মীয়দের সাহায্যে কোন ওরকমে সংসার চলে।
ছবিটা আরও করুণ ডায়মন্ড হারবার রায়নগর ক্ষেত্রনাথ সুনীলবরণ পৌর বিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়া সুমন পুরকাইতের। স্টার মার্কস পেয়েও পছন্দের বিষয় ইংরেজি নিয়ে পড়তে পারবে কিনা, তা নিয়ে চিন্তায় সুমন ও তার পরিবার। দলনঘাটার কাছে সুমনের বাবা রমেনবাবু গ্রিেলর দোকানের একজন সামান্য কর্মচারী। বাড়িতে সুমনের একটি ভাই, দাদু ঠাকুমা মিলিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারের খরচ টানা তাঁর পক্ষে বেশ কষ্টকর। রমেনবাবুর কথায়, ‘‘ছেলে তো আরও পড়তে চাইছে, কিন্তু কী ভাবে ওর পড়াশোনার খরচ চালাব, তা আমার মাথায় আসছে না। একটু সাহায্য পেলে হয় তো পড়াতে পারব ছেলেটাকে।’’ সুমন উচ্চমাধ্যমিকে ৩৮৩ পেয়েছে। কোনও গৃহশিক্ষক ছিল না তার। স্কুলের শিক্ষকদের সাহায্য নিয়েই এতটা পথ চলেছে সে।
বড় স্বপ্ন চোখে থাকলেও প্রায় একই কারণে পিছিয়ে আসার উপক্রম হয়েছে কাকদ্বীপ গণেশপুর তৃতীয় ঘেরির আকাশ মাইতিকে। কাকদ্বীপ বীরেন্দ্র বিদ্যানিকেতন থেকে পাশ করা ওই মেধাবী ছাত্রটির প্রাপ্ত নম্বর ৯৪ শতাংশ। আকাশের কথায়, ‘‘সুন্দরবনের ছেলে আমি। তাই মৎস্যবিদ্যা নিয়ে পড়তে চাই। ভবিষ্যতে সামুদ্রিক মাছের উপর গবেষণার ইচ্ছে রয়েছে।’’ কিন্তু স্বপ্নের এই উড়ান বাস্তবের মাটিতে ঠোক্কর খাচ্ছে। বাবা হিমাদ্রিশেখর গৃহশিক্ষকতা করে সংসার চালান। ছেলেকে কলকাতায় রেখে পড়ানোর কথা মাথায় আনতেই পারছেন না তিনি। স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবব্রত দাস বলেন, ‘‘ছেলেটা গবেষণা করে সুন্দরবনের মৎস্যজীবীদের জন্য একটা দৃষ্টান্তমূলক কিছু করতে চাইছে। আমরা পাশে রয়েছি সাহায্যের জন্য, কিন্তু তা বোধহয় যথেষ্ট নয়।’’ তিন মেধাবীর জন্য পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে স্কুলের শিক্ষকেরা।
কিন্তু পরিবারের অসহায়তার কারণে ওদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যাবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।