বধূর ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার, পিটিয়ে খুন শাশুড়িকেও

বছর সাতচল্লিশের মহিলাকে বাঁধা হয়েছিল তেঁতুলগাছের সঙ্গে। তখন বেশ রাত ঘনিয়েছে। আলোর বন্দোবস্ত করতে পাশের একটি বাড়ি থেকে বিদ্যুতের লাইন টানা হয়। আলো জ্বলে। তারপরে শুরু বেদম বেদম প্রহার। পুলিশ যতক্ষণে মহিলাকে উদ্ধার করে, ততক্ষণে দেহে আর প্রাণ নেই।

Advertisement

শান্তশ্রী মজুমদার

সাগর শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০১৬ ০০:৪৪
Share:

এই গাছেই বেঁধে মারা হয় লক্ষ্মী লায়াকে। গাছে লাগানো হয়েছিল আলো। ইনসেটে, লক্ষ্মীর বৌমা শম্পা। নিজস্ব চিত্র।

বছর সাতচল্লিশের মহিলাকে বাঁধা হয়েছিল তেঁতুলগাছের সঙ্গে। তখন বেশ রাত ঘনিয়েছে। আলোর বন্দোবস্ত করতে পাশের একটি বাড়ি থেকে বিদ্যুতের লাইন টানা হয়। আলো জ্বলে। তারপরে শুরু বেদম বেদম প্রহার। পুলিশ যতক্ষণে মহিলাকে উদ্ধার করে, ততক্ষণে দেহে আর প্রাণ নেই।

Advertisement

এই ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে ওই মহিলার বৌমার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল। ওই তরুণীকে খুনের অভিযোগেই শাশুড়িকে পিটিয়ে মারে জনতা।

বৃহস্পতিবার গভীর রাতে ঘটনাটি ঘটেছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগর থানার ধসপাড়া ১ পঞ্চায়েতের নগেন্দ্রনাথ গ্রামে। মারধরের খবর পেয়ে গ্রামে গেলে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয়। পিটিয়ে মারার ঘটনায় শুক্রবার রাত পর্যন্ত এখনও পর্যন্ত ১৮ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

Advertisement

পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শম্পা লায়া (২৭) নামে এক বধূর ঝাউগাছে ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। ওই রাতেই শম্পাদেবীর শাশুড়ি লক্ষ্মী লায়াকে তেঁতুল গাছে বেঁধে পিটিয়ে মারা হয়।

পুলিশ এবং স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, গঙ্গাসাগর পঞ্চায়েতের শ্রীধাম গ্রামে একই বাড়িতে থাকতেন শম্পাদেবী, তাঁর স্বামী সুখদেববাবু এবং শাশুড়ি লক্ষ্মীদেবী। তবে তাঁদের হাঁড়ি ব্যবস্থা আলাদা ছিল। বছর আটেক আগে শম্পাদেবী এবং সুখদেববাবুর বিয়ে হয়। তাঁদের ছয় এবং তিন বছরের দু’টি ছেলে রয়েছে। বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই মাঝে মধ্যেই শম্পাদেবীর সঙ্গে স্বামী এবং শাশুড়ির অশান্তি হতো। অশান্তি মেটাতে বার কয়েক সালিশি বসেছে। শম্পার স্বামী স্থানীয় একটি পান বরজে কাজ করেন। লক্ষ্মীদেবীর স্বামী কেরলে কেরলে শ্রমিকের কাজ করেন।

বুধবার রাতে স্বামীর সঙ্গে ফের অশান্তি হয় শম্পাদেবীর। বৃহস্পতিবার বাড়িতে হাঁড়ি চড়েনি। বৃহস্পতিবার বিকেলের দিকে পোষা গরুর জন্য বাড়ি-সংলগ্ন মাঠে ঘাস কাটতে যান শম্পাদেবী। কিন্তু সন্ধ্যা নামলেও ঘরে ফেরেননি। খুঁজতে বেরিয়ে বাড়ি থেকে প্রায় ২০০ মিটার দূরে একটি ঝাউগাছে পুরনো সিল্কের কাপড়ে বাঁধা অবস্থায় স্ত্রীকে ঝুলতে দেখেন সুখদেববাবু। তিনি দেহটি নামিয়ে স্থানীয় পঞ্চায়েতের উপপ্রধান তপন নায়েককে ফোন করেন। তপনবাবু সাগর কোস্টাল থানায় খবর দেন। পুলিশ দেহটি উদ্ধার করে নিয়ে যায় এবং স্বামীকে আটক করে।

এরপরেই শুরু হয় পাল্টা গোলমাল। শম্পাদেবীর বাপের বাড়ি সাগরেরই নগেন্দ্রগঞ্জ এলাকায়। সেখানকার লোকজন ঘটনার খবর পেয়ে তিনটি গাড়ি করে শ্রীধাম গ্রামে যান। পুলিশ কেন তাঁদের না জানিয়ে দেহ নিয়ে চলে গেল, সেই প্রশ্ন তুলে বিক্ষোভ শুরু হয়।

গোলমাল বাড়ছে দেখে শম্পাদেবীর শাশুড়ি পাশের গ্রাম মহেন্দ্রগঞ্জে তাঁর বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হন। তখন তাঁকে আটকে গাড়িতে তুলে নগেন্দ্রগঞ্জে নিয়ে যায় কিছু লোক। সেখানে একটি তেঁতুলগাছে বাঁধা হয় তাঁকে। অন্ধকারে যাতে দেখতে অসুবিধা না হয়, সে জন্য পাশের বাড়ি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ নিয়ে তেঁতুলগাছে আলো লাগানো হয়। এরপরে শুরু হয় বেধড়ক মারধর।

খবর পেয়ে সাগর এবং সাগর কোস্টাল থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে যায়। পুলিশকেও বাধা দেওয়া হয়। ইট ছোড়া হয়। স্থানীয় তৃণমূল নেতারা গেলে তাঁদেরও ধাক্কাধাক্কি করা হয়। রাত সাড়ে ১২টা নাগাদ লক্ষ্মীদেবীকে উদ্ধার করে পুলিশ সাগর গ্রামীণ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন।

শুক্রবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেল, গ্রাম কার্যত পুরুষশূন্য। গাছে ঝুলছে একটি সিএফএল ল্যাম্প। কয়েকজন বৃদ্ধ, মহিলা এবং শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছেন। স্থানীয় বাসিন্দা চম্পা জানা বলেন, ‘‘পুলিশ বাপের বাড়ির লোকেদের না দেখিয়ে শম্পাদেবীর দেহ নিয়ে চলে গিয়েছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই শাশুড়িকে এই গ্রামে টেনে আনা হয়। তবে আমার শাশুড়ি অসুস্থ থাকার আমি ঘটনাস্থলে যাইনি।’’

পুলিশ সুয়োমোটো মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার মাঝ রাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত ৬ জন মহিলা-সহ ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। রাতে দু’পক্ষ থেকেই পুলিশের কাছে আলাদা করে আত্মহত্যার প্ররোচনা এবং পিটিয়ে মারধরের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। কাকদ্বীপের এসডিপিও অশেষবিক্রম দস্তিদার বলেন, ‘‘মহিলাকে পিটিয়ে মারা, পুলিশের উপরে আক্রমণ, সাধারণ মানুষকে মারধরের অভিযোগে ১৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।’’ প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, শম্পাদেবী পারিবারিক বিবাদের জেরে আত্মঘাতী হয়েছেন। তবে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট না এলে চূড়ান্ত কিছুই বলা যাবে না বলে জানাচ্ছে পুলিশ।

স্থানীয় বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা বলেন, ‘‘বধূকে মারার অভিযোগ থাকলেও আইন হাতে নিয়ে কাউকে মেরে ফেলা ঠিক নয়। পুলিশ নিরপেক্ষ তদন্ত করবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন