অঙ্কে নজর কম, প্রভাব পড়ছে ফলে

অঙ্কের জ্যামিতি ক্লাসের দিন স্কুলে অনুপস্থিত পড়ুয়ারা। যে ক’জন উপস্থিত, তাদেরও সকলের কাছে নেই জ্যামিতি বাক্স। এ দিকে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে অঙ্কে টেনেটুনে ৫০ শতাংশ নম্বর তুলতে কালঘাম ছুটছে পড়ুয়াদের। ছবিটি কোনও একটি স্কুলের নয়। এর পেছনে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের সচেতনতার অভাব বা আর্থিক অসঙ্গতির পাশাপাশি শিক্ষকের অনীহাকে, কখনও বা পরিকাঠামোকেও দায়ী করছেন বিভিন্ন মহল।

Advertisement

শান্তশ্রী মজুমদার

ডায়মন্ড হারবার শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:০২
Share:

অঙ্কের জ্যামিতি ক্লাসের দিন স্কুলে অনুপস্থিত পড়ুয়ারা। যে ক’জন উপস্থিত, তাদেরও সকলের কাছে নেই জ্যামিতি বাক্স। এ দিকে পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে অঙ্কে টেনেটুনে ৫০ শতাংশ নম্বর তুলতে কালঘাম ছুটছে পড়ুয়াদের। ছবিটি কোনও একটি স্কুলের নয়। এর পেছনে প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের সচেতনতার অভাব বা আর্থিক অসঙ্গতির পাশাপাশি শিক্ষকের অনীহাকে, কখনও বা পরিকাঠামোকেও দায়ী করছেন বিভিন্ন মহল।

Advertisement

ডায়মন্ড হারবারের ধনবেড়িয়া হাইস্কু‌লের পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে অঙ্কে ৫০ শতাংশের উপরে নম্বর পেয়েছে গড়ে মাত্র ৭ জন পড়ুয়া। নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনাতে গিয়ে অঙ্কের শিক্ষক শরদিন্দু হাতি বললেন, “৮০ শতাংশ ছাত্রছাত্রীই জ্যামিতি ছোঁয় না। মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের কাছে জ্যামিতি একটা বড় সমস্যা।” শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা বলছে, জ্যামিতি বাক্স কেনার ক্ষমতাই নেই অনেকের। উপরন্তু জ্যামিতির সরঞ্জাম ব্যবহার করা নিয়েও উপযুক্ত সচেতনতা তৈরি হচ্ছে না। ফলে সম্পাদ্য এবং উপপাদ্য এড়িয়ে যাওয়ার ধারা বহাল থাকছে।

মাছ ধরে কোনও রকমে সংসার চালান কল্পনা দাস। ছেলের জ্যামিতি বাক্স নেই কেন? এই প্রশ্নের কী জবাব দেবেন বুঝে উঠতে হিমশিম খেলেন ধনবেড়িয়া হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রের ওই অভিভাবক। ক্লাসের এক একটি বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় ছেলেমেয়ের পড়াশোনার দিকে বাবা-মায়েদের নজর দিতে বলছে স্কুল। কিন্তু প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সে প্রসঙ্গও অবান্তর।

Advertisement

কিছুটা ভিন্ন ছবি অবশ্য চোখে পড়ল মেয়েদের স্কুলে। মূলত মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছাত্রীদের নিয়েই চলে ডায়মন্ড হারবার গার্লস হাইস্কুল। স্কুলের অঙ্কের শিক্ষিকা তৃষিতা দাস জানালেন, তাঁদের ছাত্রীদের মধ্যে আবার জ্যামিতিকে ভর করেই নম্বর পাওয়ার চল বেশি। তা ছাড়াও বীজগণিত এবং গ্রাফের উপরেও জোর দেওয়ার রেওয়াজ আছে এই স্কুলে। তবে তুলনামূলক ভাবে অঙ্কের ফল ভাল হলেও পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে ৬০ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়েছে প্রায় ২৫ শতাংশ ছাত্রী। ফলে জ্যামিতি ছাড়াও এই ফলাফলের পেছনে আরও কয়েকটি কারণ তুলে ধরছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান শিক্ষক দীপ্তেসানন্দ বলেন, “কিছু শিক্ষক পুরনো কায়দা আঁকড়েই পড়ানো চালিয়ে যাচ্ছেন। তার ফলেও ছাত্রছাত্রীদের ক্ষতি হচ্ছে।” তিনি জানালেন, এখন বেশির ভাগ স্কুলে এনসিইআরটির ধাঁচে প্রজেক্ট ওয়ার্ক, মডেলের মাধ্যমে পড়ানোর কথা। কিন্তু বেশ কিছু শিক্ষকই সে পথ মাড়ান না। তাঁর দাবি, “সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকেরাও পড়ানোর পুরনো ধাঁচ থেকে বেরোতে পারছেন না।” সরিষা রামকৃষ্ণ মিশনের পঞ্চম থেকে অষ্টম শ্রেণির অঙ্কের গড় ফলও খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ডায়মন্ড হারবার এবং কাকদ্বীপের অতিরিক্ত স্কুল পরিদর্শকের দফতর সূত্রেও জানা গেল, সরকারের তরফে আয়োজিত ওরিয়েন্টেশন ক্যাম্পগুলির (অল্প দিনের প্রশিক্ষণ শিবির) প্রতিও তেমন গুরুত্ব দেন না শিক্ষকেরা। ফলে স্কুলে গিয়েও তার ঠিক মতো বাস্তব প্রয়োগ হয় না। জেলা স্কুল পরিদর্শক দেবজ্যোতি বড়ালের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে প্রশিক্ষণের যথাযথ প্রয়োগ না করতে পারার জন্য পরিকাঠামোকেই দায়ী করছেন অঙ্ক শিক্ষকেরা। কাকদ্বীপের অন্যতম সেরা স্কুল বীরেন্দ্র বিদ্যাপীঠের অঙ্ক শিক্ষক প্রসূন দাস এই প্রজন্মের। তাঁর মতে, “ওরিয়েন্টেশন ক্যাম্প করে আসার পর প্রথম প্রথম সকলের উৎসাহ থাকে নতুন ভাবে কিছু করানোর। কিন্তু এক এক জন শিক্ষকের পক্ষে ক্লাসের ৬০-৭০ জন পড়ুয়াকে হাতে কলমে অঙ্ক শেখানো মুশকিল।” এই স্কুলে ৫০ শতাংশ এবং তার বেশি পেয়েছে ১৭ শতাংশের একটু বেশি ছাত্র। ৬০ শতাংশের সীমা পার করতে পেরেছে ১২ শতাংশের কাছাকাছি ছাত্র। আর ৮০ শতাংশ বা তার বেশি পেয়েছে সাড়ে তিন শতাংশ ছাত্র।

অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল উঠে যাওয়ার জন্যও কিছু কিছু স্কুলে অন্য বিষয়ের মতো অঙ্ক শেখার গুরুত্ব একেবারেই হারিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করছেন শিক্ষকরা। যার ফল হচ্ছে মারাত্মক। নবম শ্রেণি থেকে দশমে ওঠার সময়ে বা মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় অনেক ছাত্রকেই পাশ করানোর ঝুঁকি নিতে পারছেন না শিক্ষকেরা। অনেক স্কুলেই আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে বা শিক্ষকদের ধমকে পাশ করিয়ে দেওয়ার রাস্তা নিচ্ছে কিছু ছাত্র। কিছু দিন আগেই বার্ষিক পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে বেশিরভাগ স্কুলে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন