এক কাঠা জমির দাম ৫-৮ লক্ষ টাকা। ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে ২০০০-২৫০০ টাকা স্কোয়ার ফুটের হিসাবে। ৪০-৫০ লক্ষ টাকায় বিক্রি হচ্ছে দোকানঘর। এক কথায় টাকা উড়ছে বসিরহাটের বাতাসে!
কিন্তু কী তার কারণ? এলাকায় কান পাতলে শোনা যাবে, প্রদীপের নীচে অন্ধকারের কথা।
বসিরহাট পুর শহরের আনাচে-কানাচে গরু পাচারের অবৈধ টাকা ওড়ে, এমন অভিযোগ দীর্ঘ দিনের। শুধু গরু নয়, সোনার বিস্কুট-সহ অন্যান্য জিনিসপত্র পাচারও চলে রমরমিয়ে। ৭১ সালের পর থেকে বহু শরণার্থী বাংলাদেশ থেকে ঘটি-বাটি বেচে চলে এসেছিলেন বসিরহাট সীমান্ত দিয়ে। তাঁদের অনেকে রাজ্যের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছেন। অনেকে থেকে গিয়েছেন এই শহরেই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে বসিরহাটে অনুপ্রবেশের সংখ্যাটা দিন দিন বাড়ছে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর কাঁচা টাকা নিয়ে এ পারে এসেছেন অনেকে। তাঁদের জীবনযাপনের রকম-সকম বসিরহাটের ভূমিপুত্রদের বেশ কোণঠাসা করেছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী সুনীল অধিকারী, হালিম মণ্ডল, রাজা অধিকারীরা বলেন, “ভোগ্যপণ্যের বিক্রি গত কয়েক বছরে হু হু করে বেড়েছে। লোকের হাতে টাকা আসছে এটা সত্যি। কিন্তু কোন পথে টাকা বাড়ছে, সে দিকেও নজর দেওয়া উচিত।” অভিযোগ, গরু, সোনা এবং নারীপাচারের অবৈধ টাকায় শহরের অনেকে ফুলেফেঁপে উঠেছে। যাদের হাত ধরে বাড়ছে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য। বড় বড় ব্যবসায়ীরা ইদানীং তোলাবাজদের আতঙ্কে জেরবার।
পাচারের সূত্র ধরে জঙ্গি অনুপ্রবেশও হচ্ছে দেদার। বসিরহাট সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশি এমনকী, পাকিস্তান থেকেও সন্ত্রাসবাদীরা ডেরা বেঁধেছে বলে বহু বার খবর পেয়েছে গোয়েন্দা দফতর। ধরাও পড়েছে অনেকে। কিন্তু অসুরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ আটকানো যায়নি। যেমন আটকানো যায়নি পাচার। কাঁটাতারহীন বিস্তীর্ণ এলাকা রয়েছে এই মহকুমায়। পুলিশ কর্তাদের একাংশের বক্তব্য, গোটা রাজ্যেই সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ধরনের সমস্যা আছে। এই সব এলাকায় বাড়তি নজরদারিও জরুরি। বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিভিন্ন সময়ে ধৃত বাংলাদেশিদের জেরা করে জানা গিয়েছে, অধিকাংশই আর্থ-সামাজিক কারণেই কাজ খুঁজতে এ পারে চলে আসছে। অনুপ্রবেশ রুখতে পুলিশ-বিএসএফ যৌথ ভাবে প্রতি নিয়ত অভিযান চলছে। প্রায় প্রতি দিনই অনুপ্রবেশকারীদের ধরা হচ্ছে। যদিও স্থানীয় মানুষের অভিজ্ঞতা অন্য কথাই বলে। দু’চার ধরা পড়লেও অনুপ্রবেশের সংখ্যাটা দিন দিন বেড়ে চলেছে বলে জানালেন বসিরহাটবাসী।
এলাকায় অপরাধ প্রবণতা বাড়ার আরও একটা কারণের কথা জানালেন প্রবীন নাগরিক অজয় বসু, অজয় মুখোপাধ্যায়রা। তাঁদের মতে, কল-কারখানা তৈরি না হওয়ায় বেকার সমস্যা বাড়ছে। শিক্ষিত প্রজন্মের অনেকে ভিড়ছে চোরাকারবারে। চাকরির জন্য কলকাতামুখী হচ্ছেন যাঁরা তাঁদের সঙ্গে আবার শহরের নাড়ির টান কমছে।
ভিনরাজ্যে যাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে গত কয়েক বছরে। কাজের সন্ধানে অন্য রাজ্যে পাচার হয়ে যাচ্ছে মেয়েরা। বহু যুবকও ভিনরাজ্যে চাকরির জন্য একে ওকে তাকে ধরে চেষ্টা করেও ব্যর্থ। বরং চাকরি পেতে টাকা দিয়েও প্রতারিত হয়েছেন বহু শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী।
২০০১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সংগ্রামপুর-বসিরহাটের মধ্যে ইছামতী নদীর উপরে কংক্রিটের সেতু তৈরি হয়। বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় সে সময়ে যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান। তাঁর কাছে বসিরহাট গ্রামীণ এলাকা বহু ছাত্রছাত্রী কয়েক হাজার চিঠি পাঠাচ্ছিল কয়েক বছর ধরেই। সেতুটির দাবি এ ভাবেই প্রণববাবুর কানে ওঠে। তাঁরই তত্ত্বাবধানে টাকার জোগাড় করে কেন্দ্র। সেতুর উদ্বোধনে প্রণববাবু নিজেও এসেছিলেন। এই সেতু বসিরহাট শহরের সঙ্গে গ্রামীণ এলাকার যোগাযোগ মসৃণ করে তোলে। ব্যবসা-বাণিজ্যও বাড়ে। সেই সঙ্গে হাসনাবাদ-বারাসত বিদ্যুৎচালিত ট্রেন চালু হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করেছে। নতুন নতুন বাস চালু হয়েছে কলকাতা-সহ অন্যান্য এলাকার মধ্যে। রেল পরিবহণ নিয়ে অবশ্য এখনও অভিযোগ আছে। অনেক জায়গায় ডবল লাইনের কাজ শেষ হয়নি এখনও। আরও ট্রেনের দাবি আছে। কিন্তু সব মিলিয়ে গত এক দশকে বসিরহাট শহরের ঝাঁ-চকচকে চেহারাটা চোখে পড়ার মতো।
বেশির ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা তৈরি হয়েছে এখানে। বহু নামি-দামি কোম্পানির শো-রুম হয়েছে। পথচলতি অসংখ্য বিশাল বিশাল বাড়ি চোখে পড়ার মতো। আদব-কায়দায় যা কলকাতাকেও হার মানায়। এখানে বহু মানুষ ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। তেমনই চাকুরিজীবীর সংখ্যাটাও কম নয়। যদিও চাকরির ক্ষেত্রে সকলেই প্রায় কলকাতামুখী।
সব মিলিয়ে বিত্তের ছাপ এখন স্পষ্ট গোটা এলাকায়। হাল ফ্যাশনের দামি মোটর বাইক আর কেতাদূরস্ত গাড়ি শহরের অলিতে-গলিতে। পোশাক-আশাকে রীতিমতো ধোপদূরস্ত নব্য বসিরহাটবাসী। পুরনো বাসিন্দা অনিল ঘোষ, শ্যামল ভৌমিক, পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, অধীর পালরা জানালেন, আগে দেখা যেত সুন্দরবন থেকে ইছামতী হয়ে একের পর এক নৌকো আসছে। তাতে হোগলা পাতা, বাঁশ, ঘুঁটে আসত। সে সব ছিল বসিরহাটবাসীর রান্নাবান্না, ঘর তৈরির উপকরণ। এখন সেই দৃশ্য আর দেখা যায় না। ঘরে ঘরে গ্যাস। মাটির বাড়ি তো চোখেই পড়ে না। রবীন্দ্রভবন, স্টেডিয়াম, টাউনহল, বিশাল পুরভবন, বৈদ্যুতিক চুল্লি, ইছামতীর ধারে পিকনিক স্পট এ সব তৈরি হয়েছে। তাঁরা বলেন, “এখন কত নতুন নতুন মুখ এলাকায়। আগে রাস্তায় বেরোলে প্রায় সকলের সঙ্গে দু’একটা কথা হত। এখন তো কাউকে চিনতেই পারি না।”
বসিরহাট শহর কোনও দিনই খুব পরিকল্পনামাফিক ছিল না। অনুপ্রবেশকারীরা এসে যত্রতত্র কলোনি তৈরি করেছেন। নালা-নর্দমা বুজিয়ে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় দোকান। যা শহরের নিকাশি ব্যবস্থার উপরে স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। নিকাশির মতোই তীব্র সমস্যা পানীয় জলের। নানা সময়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে বহু জলপ্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছে বসিরহাট পুর শহরে। সে জন্য কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সুসংহত পরিকল্পনার অভাবে কিছু দিন যেতে না যেতেই মুখ থুবড়ে পড়েছে সেই সব প্রকল্প। ২২টি ওয়ার্ডের সর্বত্র নলবাহিত জল চালু হলেও তা কতটা পানের যোগ্য, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গিয়েছে। ব্রিটিশ আমলে ত্রিমোহিনী থেকে ইটিন্ডা রোড বরাবর জলের পাইপ লাইন তৈরি হয়েছিল। মাটির তলার জল তুলে পরিস্রুত করে সরবরাহ হত। সেই পাইপ লাইন ব্যবহার হয় এত বছর পরেও। কিন্তু জরাজীর্ণ পাইপ ফাটে মাঝে মধ্যেই। দূষিত
সম্প্রতি পুরবোর্ড উল্টে গিয়ে কংগ্রেসের হাত থেকে ক্ষমতা এসেছে তৃণমূলের হাতে। বসিরহাট শহরকে উন্নত করতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে মাস্টার প্ল্যান তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী তথা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা তৃণমূল সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। তাঁর দাবি, এত বছরেও বাম ও কংগ্রেস পুরবোর্ডে থেকে কোনও উন্নতি করতে পারেনি শহরের। বিরোধীদের আবার বক্তব্য, সামনেই বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রের উপনির্বাচন। ওই এলাকার মধ্যেই পড়ে বসিরহাট পুরসভা। প্রতিশ্রুতির সবটাই ভোটের রাজনীতির দিকে তাকিয়েই নাকি করছে তৃণমূল। রাজনৈতিক চাপানউতোরের মধ্যে না পড়ে বসিরহাটবাসী অবশ্য চাইছেন এলাকার সার্বিক উন্নয়ন।
(চলবে)