আইসিকে সরানোর পিছনে আসল কারণ কী, চলছে জল্পনা

কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে সাসপেন্ড করা হল বসিরহাট থানার আইসি সৌমশান্ত পাহাড়িকে। একই কারণে দিন কয়েক আগে সাসপেন্ড হয়েছেন থানার এক সাব ইন্সপেক্টরও। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) গৌরব লাল জানান, বসিরহাট থানার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিআইকে। গোটা ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

Advertisement

নির্মল বসু

বসিরহাট শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:৪০
Share:

কর্তব্যে গাফিলতির অভিযোগে সাসপেন্ড করা হল বসিরহাট থানার আইসি সৌমশান্ত পাহাড়িকে। একই কারণে দিন কয়েক আগে সাসপেন্ড হয়েছেন থানার এক সাব ইন্সপেক্টরও। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) গৌরব লাল জানান, বসিরহাট থানার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিআইকে। গোটা ঘটনা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

Advertisement

ঘটনার সূত্রপাত গত ১৬ ডিসেম্বর। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই সন্ধ্যায় বসিরহাটের সাঁইপালার প্রোমোটার বাপ্পা বসুর স্ত্রী জয়শ্রী দুষ্কৃতীদের হাতে আক্রান্ত হন। নানা অভিযোগ থাকায় বেশ কিছু দিন এলাকা ছাড়া বাপ্পা। এক দল দুষ্কৃতী তাঁর বাড়িতে ঢুকে হামলা চালায় বলে অভিযোগ। পাড়া-পড়শিরা তাড়া করলে একটি মোটর বাইক ফেলে পালা দুষ্কৃতীরা। ভাই দেবাশিস বিশ্বাস ওরফে বাবাইকে সঙ্গে নিয়ে ওই সন্ধ্যাতেই থানায় ১৫ জনের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন জয়শ্রীদেবী। তাঁরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বলে লিখিত ভাবে জানান পুলিশকে। সন্ধে সাড়ে ৭টা নাগাদ পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে আসে। দুষ্কৃতীদের ফেলে যাওয়া মোটরবাইকটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায় তারা।

থানা থেকে ফিরে দিদি জয়শ্রীকে সাঁইপালাতেই নিজের বাড়িতে নিয়ে যান দেবাশিস। তারপর বাড়ির বাইরে বেরোন। রাত পৌনে ১০টা নাগাদ বাড়ির কাছেই এক দল দুষ্কৃতী তাঁর উপরে বোমা-গুলি নিয়ে হামলা চালায়। ঘটনাস্থলেই মারা যান দেবাশিস।

Advertisement

দুষ্কৃতীদের নামে নির্দিষ্ট অভিযোগ করা সত্ত্বেও পুলিশ কেন অভিযোগকারীদের নিরাপত্তা দিতে পারল না, সেই প্রশ্ন ওঠে। জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, গাফিলতির অভিযোগে শো-কজ করা হয় আইসিকে। ঘটনার দু’দিন বাদে, গত ১৮ ডিসেম্বর থানার এসআই প্রতীক বসুকে সাসপেন্ড করা হয়। ২৫ তারিখ সাসপেন্ড হন আইসি। বসিরহাট থানার দায়িত্বে এসেছেন স্বরূপনগরের সিআই সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়কে। খুনের তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এখনও পর্যন্ত ওই ঘটনায় অভিযুক্ত দু’জন সহ ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের খোঁজ চলছে।”

তবে আইসিকে সরিয়ে দেওয়ার পিছনে শুধু এই একটি মাত্র কারণ ছাড়াও অন্য কারণও থাকতে পারে বলে মনে করেন জেলা পুলিশ মহলের একাংশ।

দুর্গাপুজোর পর থেকেই বসিরহাটে একের পর এক চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়ছিল। মোটর বাইকে আসা দুই যুবক বসিরহাটের অনন্তপুর গ্রামে মাজেদ গাজির বাড়িতে ঢুকে তার ছেলের বৌ আম্বিয়া বিবির গলায় ছুরি ধরে খুনের হুমকি দিয়ে ডাকাতি করে পালায়। একই রাতে বসিরহাট থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে বড় কালীবাড়ি পাড়ায় একটি মন্দিরের দরজা ভেঙে ঢুকে অষ্টধাতুর কালীমূর্তি-সহ প্রায় ৫ লক্ষ টাকার সোনা ও রূপার অলঙ্কার, প্রণামীর টাকা নিয়ে পালায় দুষ্কৃতীরা। ইটিন্ডার কাজল সর্দারের বাড়ি থেকে দুষ্কৃতীরা নগদ বেশ কয়েক হাজার টাকা, কয়েক ভরি গয়না, ৩টি মোবাইল লুঠ করে। ভ্যাবলায় জগন্নাথ দাস এবং স্বপন বিশ্বাসের বাড়িতে দরজার-জানালা ভেঙে ঢুকে দুষ্কৃতীরা বেশ কয়েক ভরি গয়না, নগদ টাকা, মোবাইল-সহ অন্য জিনিসপত্র লুঠ করে পালায়। ভবাণীপুরের বাসিন্দা বিশ্বজিৎ দাসের বাড়ির দরজার তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে দুষ্কৃতীরা লক্ষাধিক টাকার সোনা-রুপোর অলঙ্কার এবং নগদ কয়েক হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে পালায়। মোটর বাইক আরোহী দুষ্কৃতীরা বসিরহাট থানার কাছে ৭২ নম্বর বাসস্ট্যান্ডের কাছে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর দোকান থেকে লক্ষাধিক টাকা মূল্যের অলঙ্কার নিয়ে চম্পট দেয়। সাঁইপালার সোনপুকুর ধারে সন্দীপন সরকার, গৌতম কুণ্ডু, অমল দত্ত এবং তাপস কুণ্ডুর বাড়িতে তালা ভেঙে ঢুকে বেশ কয়েক লক্ষ টাকার গয়না, মোবাইল, ক্যামেরা, অন্য জিনিসপত্র লুঠ হয়। নতুন বাজার, বড় জিরাফপুর, ভবাণীপুর, মৈত্রবাগান, মুন্সিবাগান এলাকার রাস্তায় পর পর কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটেছে। এই ভাবে একের পর এক ঘটনার পরেও দুষ্কৃতীদের উপদ্রব বন্ধ না হওয়ায় বিরক্ত শহরবাসী। ফলে আইসিকে সরিয়ে দেওয়ায় শহরবাসীর একটা বড় অংশই খুশি।

কিন্তু শুধু কী নিষ্ক্রিয়তাই এই পদক্ষেপের কারণ? নাকি আরও কিছু প্রভাব আছে পুলিশ মহলের এই সিদ্ধান্তের পিছনে, উঠছে সেই প্রশ্নও।

দুর্গাপুজোর ভাসান নিয়ে বসিরহাটে তুলকালাম বাধে। ক্লাবগুলির সঙ্গে সমন্বয় সাধনের ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা সমালোচিত হয়। এ ছাড়াও নানা ঘটনায় আইসি-র শাসক দলের একটি গোষ্ঠীর বিরাগভাজন হয়ে ওঠার প্রসঙ্গ।

বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসভা উপনির্বাচনের কয়েক দিন আগে শাসকদলের এক গোষ্ঠীর এক প্রভাবশালী নেতার চাপে হঠাৎই সরতে হয়েছিল বসিরহাট থানার তৎকালীন আইসি প্রসেনজিৎ দাসকে। ভোটের মুখে নতুন আইসি সৌমশান্তবাবু বসিরহাট থানায় যোগ দেন। কিন্তু কিছু কারণে বিতর্ক দানা বাঁধে তাঁকে নিয়ে।

বসিরহাট জেলা হাসপাতালের সামনে কংগ্রেস এবং তৃণমূল যেখানে নির্বাচনী সভা করছে, সেখানে সভা করার অনুমতি থাকা সত্ত্বেও বিজেপিকে আটকানো হয়। যা নিয়ে হুলস্থূল বাধে। আমজনতার মধ্যে তা নিয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ফলে তৃণমূলের জেলার এক শীর্ষ নেতা আইসি-র সমালোচনা করেন বলে দলেরই অন্দরের খবর। যদিও ওই ঘটনায় আইসি-র পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন জেলার আর এক প্রভাবশালী নেতা। ভোটের ফলাফলে তৃণমূল প্রার্থী দীপেন্দু বিশ্বাসকে সামান্য ব্যবধানে হারিয়ে দেন বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য।

যে মাঠ থেকে বিজেপি তাদের প্রায় সমস্ত অনুষ্ঠানের সূচনা করে থাকে, সম্প্রতি সেই মাঠে থানার উদ্যোগে একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। আইসি-র নির্দেশেই অনুষ্ঠান মঞ্চে গেরুয়া কাপড় লাগানো হয়েছিল বলে অভিযোগ ওঠে। স্বভাবতই যা শাসক দলের কাছে বিরক্তির কারণ ছিল। একেবারে শেষ লগ্নে গেরুয়া কাপড় ঢাকতে সাদা কাপড় মুড়ে দেওয়া হয় মঞ্চে। আইসি-র সঙ্গে বিজেপির ঘনিষ্ঠতা তৈরি হচ্ছে কিনা, তা নিয়েও স্থানীয় মহলে জল্পনা শুরু হয়।

এ ছাড়াও, নতুন থানার দায়িত্বে আসার পরে বেশ কিছু মানুষ, যাঁরা বাইরে থেকে নানা ভাবে থানার ছোটখাট কোনও কাজে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়। শাসক দলের এক মন্ত্রীর নির্দেশ সত্ত্বেও সীমান্ত এলাকায় পণ্যবাহী ট্রাক থেকে তোলা আদায় বন্ধ করতে না পারা নিয়েও প্রশ্ন উঠছিল আইসি-র ভূমিকায়। সব মিলিয়ে শাসক দলের একটি প্রভাবশালী অংশের কাছে চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন আইসি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন