আর কত রক্ত ঝরবে, প্রশ্ন ছয়ঘরিয়ার মানুষের

কাঁচা টাকা উড়ছে বাতাসে। আর তারই টানে বাড়ছে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য। গত পনেরো বছরে নাওভাঙা নদী দিয়ে জল যত না গড়িয়েছে, বনগাঁর সীমান্তবর্তী পেট্রাপোল এলাকার ছয়ঘরিয়া, পিরোজপুর, কালিয়ানি, খেদাপাড়া, নরহরিপুরে রক্ত ঝরেছে তারও বেশি, এমনটাই মনে করেন গ্রামের মানুষজন! “এমনিতেই এলাকায় ছেলেছোকরারাও হাতে মেশিন নিয়ে ঘোরে’’ বলছিলেন এক প্রবীণ মানুষ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বনগাঁ শেষ আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২০
Share:

হুজুর আলি।

কাঁচা টাকা উড়ছে বাতাসে। আর তারই টানে বাড়ছে দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য। গত পনেরো বছরে নাওভাঙা নদী দিয়ে জল যত না গড়িয়েছে, বনগাঁর সীমান্তবর্তী পেট্রাপোল এলাকার ছয়ঘরিয়া, পিরোজপুর, কালিয়ানি, খেদাপাড়া, নরহরিপুরে রক্ত ঝরেছে তারও বেশি, এমনটাই মনে করেন গ্রামের মানুষজন! “এমনিতেই এলাকায় ছেলেছোকরারাও হাতে মেশিন নিয়ে ঘোরে’’ বলছিলেন এক প্রবীণ মানুষ। কাজেই সোমবার উত্তর ছয়ঘরিয়া মোড়ের কাছে ভিড় রাস্তায় দুষ্কৃতীদের তাণ্ডবে তাঁরা আতঙ্কিত হতে পারেন, তবে বিস্মিত নন একেবারেই।

Advertisement

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত-সংলগ্ন পঞ্চায়েত বনগাঁ ব্লকের ছয়ঘরিয়া। বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। কাছেই পেট্রাপোল এলাকায় দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর। আশপাশের এলাকা দিয়ে চলে চোরাচালান। সবই চোখ-সওয়া এলাকার মানুষজনের। ‘ধুর’ পাচার (বেআইনি ভাবে দালাল ধরে মানুষের যাতায়াত), হেরোইন পাচার তো ছিলই। আর আছে গরু পাচার। সোনা পাচারের হিড়িকও বেড়েছে। পেট্রাপোল ও পিরোজপুরে কাঁটাতার নেই। চোরাচালানের স্বর্গরাজ্য। বাসিন্দাদের কথায়, “এখানে বাতাসে টাকা ওড়ে। যার দখল নিতেই দুষ্কৃতীদের মধ্যে মারপিট লেগেই থাকে। অনেক সময়ে যার খেসারত গুণতে হয় সাধারণ মানুষকেও। সোমবার যেমন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তরুণী শিক্ষিকা অদিতি অধিকারী।

ছয়ঘরিয়া এলাকায় তৃণমূল নেতা হুজুর আলি শেখের দাপট রয়েছে রীতিমতো। তাঁকে খুন করতেই সোমবার হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে গুলি লাগে অদিতি। আগে ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য ছিলেন হুজুর। এখন সদস্য পদ নেই। কিন্তু প্রতাপ আছে। বছর কয়েক আগে তাঁর ছেলের নাম জড়ায় একটি খুনের ঘটনায়। সিপিএমের দাবি, দুষ্কৃতীদের নিজেদের মধ্যে গোলমালের জেরেই হুজুরের উপরে আক্রমণ ঘটেছে। কিন্তু সে কথা স্বভাবতই মানছেন না হুজুর। তিনি জানান, কোনও বেআইনি কাজের সঙ্গে তিনি যুক্ত নন। তাঁর জমিজমা আছে। মতিগঞ্জ হাটে পাইকারি বাজারে ফসল বিক্রি করেন তিনি। সোমবার সেই কাজ সেরেই ফেরার পথে হামলার চেষ্টা হয় হুজুরের উপরে। ওই তৃণমূল নেতার দাবি, স্রেফ রাজনৈতিক কারণেই হামলা চালায় সিপিএমের লোকজন। দুই দুষ্কৃতীর নামে থানায় অভিযোগও জানিয়েছেন তিনি। ছয়ঘরিয়া এলাকার অনেকেরই বক্তব্য, হুজুরের দাপটে এলাকায় ঢুকতে সাহস পায় না কিছু দুষ্কৃতী। তাদের রাগ থাকতে পারে তৃণমূলের জনপ্রিয় এই নেতার উপরে।

Advertisement

এখানেই হামলা চলে।

সিপিএম নেতৃত্ব অভিযোগ মানেননি। তাঁদের দাবি, বেআইনি কারবারের বখরা নিয়ে দুষ্কৃতীদের গোলমালের জেরেই এই ঘটনা। তা হলে হুজুরেরও কি হাত আছে বেআইনি কারবারে? সে ব্যাপারে অবশ্য নিরুত্তর সিপিএম নেতৃত্ব।

দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যের পিছনে সীমান্তে বিএসএফের কাজকর্ম নিয়ে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ বিস্তর। অভিযোগ, বিএসএফের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা অনায়াসে এ পারে যাতায়াত করে। গুলি চালানোয় নিষেধাজ্ঞা থাকায় গত কয়েক বছর হল বিএসএফ যেন আরও হাত গুটিয়ে নিয়েছে। সে কথা মানতে চাননি বিএসএফ কর্তৃপক্ষ। এলাকার এক প্রবীণ মানুষ বললেন, “জওয়ানেরা যদি মনে করেন, তা হলে এলাকায় মাছিটুকু ঢুকতে পারত না। আমরাও শান্তিতে থাকতে পারতাম। কিন্তু তেমনটা ডান-বাম কোনও আমলেই দেখলাম না।” এলাকা থেকে পাওয়া পরিসংখ্যান বলছে, গত পনেরো বছরে জয়ন্তীপুর ও কালিয়ানিতেই ৫ জন খুন হয়েছে। গুলি-বোমায় জখমের সংখ্যার ইয়ত্তা নেই। এখানকার জামতলা এলাকায় বসে হেরোইনের হাট। দূরদূরান্ত থেকে অনেকে আসে নেশার টানে। বলাইবাহুল্য নেশার ঠেকে অসামাজিক লোকজনের আনাগোনা লেগেই থাকে। তাদের নিজেদের মধ্যেও খুন-জখম-মারামারি চলে। সাম্প্রতিক সময়ে এখানেই একে একে খুন হয়েছেন মজনু কারিগর, তার এক ছেলে, রসিদ মণ্ডল, নাসির মণ্ডল। ছয়ঘরিয়ার এক বাসিন্দার কথায়, “কারা খুন হচ্ছে এটা বড় কথা নয়। এলাকার মানুষের রক্ত ঝরছে, পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে, সব সময় যেন আতঙ্কে থাকতে হয়।”

পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, “বন্দর এলাকায় দিনের বেলায় প্রকাশ্যে খুনের ঘটনা ঘটে। রাতে ট্রাক থেকে মালপত্র চুরি হয়। ছিনতাইও হয় আকছার। এখানে নিরাপত্তা বলে কিছু নেই।” এলাকার এক বাসিন্দার কথায়, “গোটা ছয়ঘরিয়াটা যেন আগ্নেয়াস্ত্রের ভান্ডারে পরিণত হয়েছে।” জানা গেল, সন্ধ্যার পরে বাংলাদেশের দুষ্কৃতীরা ঢুকে পড়ে। স্থানীয় দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তাদের আতাঁত রয়েছে। প্রায় দিনই গুলি-বোমার শব্দ শোনা যায়।

এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, গোটা এলাকায় নানা বেআইনি কারবার চলে। যাদের হাতে টাকার দখল, তারাই এলাকা শাসন করে। সব রাজনৈতিক দলেরই তাতে কমবেশি মদত থাকে বলে এলাকার মানুষের অভিযোগ। এখানে বেশ কয়েকটি ঘাট আছে, যেখান দিয়ে নানা পাচারের কাজ চলে বাংলাদেশে। ওই ঘাটের দখল নেওয়াকে কেন্দ্র করে এখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ। প্রায়ই দেখা যায়, দুষ্কৃতীরা এখানে এসে খুন-জখম করে বাংলাদেশে পালিয়ে যাচ্ছে। এমনকী, খুন করে দুষ্কৃতীরা ফিরে যাওয়ার সময়ে বিএসএফ জওয়ান বাধা দিতে গেলে তাকেও কোপানো হয়েছে, এমন ঘটনাও দেখেছে ছয়ঘরিয়া।

আর এত সব কথা পুলিশ-প্রশাসন যে জানে না, এমনটাও হতেই পারে না। গ্রামবাসীরা জানালেন, মাঝে মধ্যে পুলিশি টহল চলে। বিএসএফও ধরপাকড় করে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়।

ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান তৃণমূলের সন্তোষ দাসের কথায়, “পুলিশ ও বিএসএফ যদি আন্তরিক ভাবে তৎপর হয়, তা হলেই একমাত্র রক্তপাত বন্ধ হওয়া সম্ভব। পুলিশ ও বিএসএফকে যৌথ ভাবে তল্লাশি করতে হবে।” এলাকার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “ওই এলাকার দুষ্কৃতীরা খুন-জখম করে বাংলাদেশে অনায়াসে পালিয়ে যাওয়া যায়। আবার বাংলাদেশ থেকে এসে দুষ্কর্ম করে নির্ভয়ে গা ঢাকা দেওয়া যায় বলেই দুষ্কৃতীমূলক কাজকর্ম বাড়ছে। বিএসএফকে বহু বার বলেছি নিরাপত্তা বাড়াতে।” কী বলছে পুলিশ? তাদের কথায়, ওই এলাকার কিছু দুষ্কৃতী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে সুযোগ বুঝে এসে খুনখারাপি করে পালাচ্ছে। সে জন্যই দুষ্কর্ম বাড়ছে। সিপিএম নেতা গোবিন্দ মণ্ডল বলেন, “বাংলাদেশ থেকে অবাধে যাতায়াত বন্ধ করতে না পারলে কাজের কাজ কিছুই হবে না।

কিন্তু সে সব থামাতে গেলে যে পদক্ষেপ করা দরকার, তার উদ্যোগ পুলিশ বা সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে কতটুকু, প্রশ্ন তা নিয়েই। তবে বিএসএফের একটি সূত্র জানাচ্ছে, এলাকার বাসিন্দারাও অনেকে পাচারের কাজে যুক্ত। নিজেদের ব্যবসা টিঁকিয়ে রাখতে দুষ্কৃতীদের প্রশ্রয় দেয় তারাও। কথাটা একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছেন না এলাকার বাসিন্দাদের একটা অংশ। কিন্তু তাঁদের পাল্টা যুক্তি, সবাই সাধুসন্ত হয়ে যাবে, তা তো কখনও সম্ভব নয়। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা তো পুলিশ-প্রশাসনকেই নিশ্চিত করতে হবে। না হলে তাঁরা বাস করবেন কীসের ভরসায়?

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন