গুলি করে যুবককে খুন, দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্তে আতঙ্কিত এলাকাবাসী

তোলাবাজি ও দুষ্কৃতীদের আনাগোনা ক্রমশ বাড়ছিল। যার ফলে আতঙ্কিত ছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। এ বার সেই আতঙ্ক আরও বাড়ল, বাড়ি থেকে এক যুবককে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে খুন করার ঘটনায়। শুক্রবার সকালে অশোকনগর থানার হরিপুর এলাকায় খোকন ওরফে বোকো দাসের (৩৮) দেহ মেলে। তার বাড়ি স্থানীয় ভাতশালা এলাকায়। নিহতের বিরুদ্ধে মাদক পাচার-সহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। কয়েক বার জেলেও খেটেছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

অশোকনগর শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২৭
Share:

তোলাবাজি ও দুষ্কৃতীদের আনাগোনা ক্রমশ বাড়ছিল। যার ফলে আতঙ্কিত ছিলেন এলাকার বাসিন্দারা। এ বার সেই আতঙ্ক আরও বাড়ল, বাড়ি থেকে এক যুবককে ডেকে নিয়ে গিয়ে গুলি করে খুন করার ঘটনায়।

Advertisement

শুক্রবার সকালে অশোকনগর থানার হরিপুর এলাকায় খোকন ওরফে বোকো দাসের (৩৮) দেহ মেলে। তার বাড়ি স্থানীয় ভাতশালা এলাকায়। নিহতের বিরুদ্ধে মাদক পাচার-সহ নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। কয়েক বার জেলেও খেটেছে। তবে কী কারণে কারা খোকনকে খুন করল, তা পুলিশের কাছে স্পষ্ট নয়। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় জানান, কয়েক মাস আগে জেল থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছিল খোকন। খুনের ঘটনায় জড়িত দুষ্কৃতীদের খোঁজ চলছে।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বৃহস্পতিবার খোকন তার স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিউ ব্যারাকপুরে বড় মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছে দিয়ে বিকেলে বাড়ি ফিরে এসেছিল। রাত ৯টা নাগাদ খোকনকে কেউ ফোন করে ডেকে নিয়ে যায়। তারপর আর বাড়ি ফেরেনি। শুক্রবার সকালে শরীর চর্চা করতে গিয়েছিলেন এলাকার কিছু মানুষজন। তাঁদের কেউ কেউ দেখতে পান, মাঠের কাছে কল্যাণগড় সংস্কৃত সঙ্ঘ শিক্ষানিকেতন স্কুলের সামনের একটি শুকনো নালায় দেহ পড়ে আছে। খবর দেওয়া হয় পুলিশকে। পুলিশ এসে দেহ উদ্ধার করে বারাসত জেলা হাসপাতালে ময়না-তদন্তের জন্য পাঠায়। নিহতের ডান দিকে কানের নীচে গুলি লেগেছিল। পাশেই পড়ে ছিল তার মাফলার-চাদর। তবে খোকনের মোবাইলটি পাওয়া যায়নি।

Advertisement

অশোকনগরের এক ব্যবসায়ী বলেন, “বাম আমল বা তৃণমূল আমল সব সময়ে একটা বিষয় এখানে ঘটেছে,
তা হল দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত। চুরি-ছিনতাই-কেপমারি-তোলাবাজির ঘটনা লেগেই আছে। রাজনৈতিক দলের
মদতে দুষ্কৃতীরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নিরাপত্তা বলে এখানে আমাদের কিছু নেই।”

কে এই খোকন? পুলিশ ও এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, দীর্ঘদিন ধরেই সে এলাকায় চোলাই ও বাংলা মদের কারবার চালাচ্ছিল। স্থানীয় ও বাইরের এলাকার দুষ্কৃতীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। বাইরের দুষ্কৃতীরা তার কাছে আসত। চোলাইয়ের কারবার চালানোর জন্য নিজস্ব দল গড়েছিল খোকন। মোবাইলে তার কাছে অর্ডার দিলে সে লোক মারফত চোলাই পৌঁছে দিত।

পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, অশোকনগরে বর্তমানে দু’টি দুষ্কৃতী দল খুবই সক্রিয়। খোকনের সঙ্গে একটি দলের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এলাকায় চোলাই কারবার চালানোর জন্য সে ওই দুষ্কৃতী দলকে তোলা দিত। অন্য দলটি সে কারণে তার উপরে ক্ষিপ্ত ছিল। কয়েক মাস আগে খোকনের বাড়িতে ওই দুষ্কৃতীরা বোমা ও গুলি চালায় বলে অভিযোগ। খোকনের গাড়িও ভাঙচুর করা হয়। পরবর্তী সময়ে মাদক পাচারের অভিযোগে খোকন পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। যে দুষ্কৃতী দল তার বাড়িতে হামলা চালিয়ে ছিল, তার পান্ডার সঙ্গে জেলে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় খোকনের। ফলে কারা তার উপরে প্রাণঘাতী হামলা চালাল, তা পরিস্কার নয় পুলিশের কাছেও। স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, অশোকনগর-কল্যাণগড় পুর এলাকায় যে কয়েকজন দাগী দুষ্কৃতী রয়েছে, তারা এখন সকলেই ইদানীং জেলের বাইরে। তাদের বাইক বাহিনী গোটা এলাকায় তাণ্ডব করে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ। দিন কয়েক আগে পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে অশোকনগর হাইস্কুলের সামনে নবম ও সপ্তম শ্রেণির দুই ছাত্রীকে বাইক আরোহী দুই দুষ্কৃতী টানাটানি করে। পর দিনই স্থানীয় ১১ নম্বর ওয়ার্ডে সন্ধ্যায় দুষ্কৃতীরা বাইকে করে এসে প্রকাশ্যে গুলি-বন্দুক নিয়ে দাপাদাপি করে। যা দেখে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ব্যাঙ্ক থেকে পেনশনের টাকা তুলে বাড়ি ফিরতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা রীতিমতো আতঙ্কিত। কেপমারেরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। কেউ নতুন জমি-বাড়ি কিনলে বা বিক্রি করলে তাকে তোলা দেওয়াটা কার্যত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাইরের দুষ্কৃতীরা এসে এখানে আশ্রয় নেয়। খুব প্রয়োজন ছাড়া মানুষ রাতে বের হন না। কিছু দিন আগে কচুয়া মোড়ে এক হোটেল মালিক তোলা না দেওয়ায় তার হোটেলে ঢুকে গুলি-বোমা চালায় দুষ্কৃতীরা। প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা। বাসিন্দারা জানান, দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য মাঝে কিছু দিন বন্ধ ছিল। ফের মাথা চাড়া দিয়েছে।

শহরের মানুষের দীর্ঘদিনের সমস্যা, আইন-শৃঙ্খলা ও দুষ্কৃতী দৌরাত্ম্য নিয়ে। দিনে-রাতে বোমাবাজি-গুলি চলে। এক ব্যবসায়ী বলেন, “বাম আমল বা তৃণমূল আমল সব সময়ে একটা বিষয় এখানে ঘটেছে, তা হল দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত। চুরি-ছিনতাই-কেপমারি-তোলাবাজির ঘটনা লেগেই আছে। রাজনৈতিক দলের মদতে দুষ্কৃতীরা ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এমনও দেখা যাচ্ছে, কোনও দুষ্কৃতী গ্রেফতার হওয়ার পরে তাকে ছাড়াতে নেতারা থানায় যাচ্ছেন বা ফোন করছেন। নিরাপত্তা বলে আমাদের কিছু নেই।”

অশোকনগরের প্রাক্তন বিধায়ক সিপিএমের সত্যসেবী কর বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, জনপ্রতিনিধিদের মদত ছাড়া দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য বাড়তে পারে না। পুলিশকে এখানে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রাখা হয়েছে। খোকন খুনের পিছনে তোলাবাজির সম্পর্ক থাকতে পারে।” অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান শর্মিষ্ঠা দত্তের অভিযোগ, “এখানে এখন আইন-শৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। দুষ্কৃতীদের বাড়বাড়ন্ত সর্বত্র।” শনিবার অন্য কয়েকটি বিষয়ের পাশাপাশি এলাকার আইন-শৃঙ্খলার অবনতির প্রতিবাদে বামেরা মিছিল করবে বলে দলীয় সূত্রে জানানো হয়েছে।

কী বলছেন পুরসভার চেয়ারম্যান তৃণমূলের সমীর দত্ত? তিনি বলেন, “খোকন একজন দুষ্কৃতী ছিল। এলাকায় দীর্ঘ দিন দুষ্কৃতীমূলক কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখানে রাজনৈতিক হিংসার ঘটনাও ঘটে না। হঠাত্‌ করে খুনের ঘটনা ঘটেছে। পুলিশকে বলেছি, দ্রুত দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করতে।” শুক্রবারই তৃণমূলের তরফে স্থানীয় পিএল ক্যাম্প এলাকায় দুষ্কৃতীমূলক কাজের বিরুদ্ধে পথসভা ও মিছিল করা হয়েছে। বিধায়ক ধীমান রায় বলেন, “সিপিএমের দুষ্কৃতীরা ওই এলাকায় একটি পরিবারকে বাড়ি ছাড়া করে দিয়েছে। তার বিরুদ্ধে পথসভা করেছি। খোকনকে খুনের পিছনে দুষ্কৃতীদের নিজেদের মধ্যে বখরা নিয়ে গোলমাল থাকতে পারে। পুলিশকে বলেছি, দ্রুত পদক্ষেপ করতে।”

এলাকার মানুষ অবশ্য বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলির যদি শান্তি ফেরাতে এতই সদিচ্ছা থাকবে, তা হলে এলাকায় আইনের শাসন দিন দিন কমছে কেন?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন