গোসাবাকে বদলে দেন স্কটল্যান্ডের হ্যামিল্টন

সমবায়ের মাধ্যমে এলাকার অর্থনীতির চেহারাটাই বদলে দিয়েছিলেন এক ভিন্-দেশি। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের হাত ধরে এগিয়েছিল গোসাবা। ‘গোসাবার রূপকার’ বলে পরিচিত হ্যামিল্টন কৃষি, তাঁতের মতো নানা ক্ষেত্রে সমবায় প্রথায় জুড়ে দিয়েছিলেন এলাকার মানুষকে। ১৯০৩ সালে স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা হ্যামিল্টন সাহেব গোসাবা ও রাঙাবেলিয়া দ্বীপে ১৪৩ ও ১৪৯ লটে প্রায় ৯০ হাজার বিঘা জমি চল্লিশ বছরের জন্য ইজারায় নেন।

Advertisement

সামসুল হুদা

গোসাবা শেষ আপডেট: ২৬ জুলাই ২০১৫ ০১:২৩
Share:

হ্যামিল্টনের বাংলো। নিজস্ব চিত্র।

সমবায়ের মাধ্যমে এলাকার অর্থনীতির চেহারাটাই বদলে দিয়েছিলেন এক ভিন্-দেশি। স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টনের হাত ধরে এগিয়েছিল গোসাবা। ‘গোসাবার রূপকার’ বলে পরিচিত হ্যামিল্টন কৃষি, তাঁতের মতো নানা ক্ষেত্রে সমবায় প্রথায় জুড়ে দিয়েছিলেন এলাকার মানুষকে।
১৯০৩ সালে স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা হ্যামিল্টন সাহেব গোসাবা ও রাঙাবেলিয়া দ্বীপে ১৪৩ ও ১৪৯ লটে প্রায় ৯০ হাজার বিঘা জমি চল্লিশ বছরের জন্য ইজারায় নেন। তখন উত্তর ২৪ পরগনার হাসনাবাদের অন্তর্গত ছিল গোসাবা ও রাঙাবেলিয়া। ম্যানগ্রোভে ঘেরা এলাকায় হ্যামিল্টনের হাত ধরেই উন্নয়নের স্রোত বইতে শুরু করে।
১৯০৩-১৯০৭ সালের মধ্যে জঙ্গল সাফ করে জনবসতি তৈরির কাজে গতি আসে গোসাবায়, যার উদ্যোক্তা ছিলেন হ্যামিল্টন। ১৯০৯ সালে সাতজেলিয়া দ্বীপে আরও ৪০ হাজার বিঘা জমি চল্লিশ বছরের জন্য ইজারায় নেওয়া হয়।
সুন্দরবনের প্রত্যন্ত এই এলাকায় উন্নয়নের বহু সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল সাহেবের উদ্যোগে। স্কটল্যান্ড থেকে মিহি উল এনে গোসাবার তাঁতে বুনে হাল্কা ওজনের (২০০ গ্রাম) উন্নত মানের শাল তৈরি করা হতো। সে যুগের সম্ভ্রান্ত বহু মানুষ গোসাবায় তৈরি শালের কদর করতেন।
কৃষকদের নিয়ে একটি বড় উদ্যোগ ছিল ‘ধর্মগোলা’। ধান কাটার সময় ধর্মগোলায় কৃষকেরা ধান জমা দিতেন। সাহেবও নিজের জমির ধান জমা রাখতেন। আশ্বিন-কার্তিক মাসে যখন প্রয়োজন দেখা দিত, তখন সেই জমা রাখা ধান চাষিরা পেতেন। কে, কত ধান নেবেন, চাষিরা তা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঠিক করতেন।

Advertisement

দরিদ্র চাষিদের আয় বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণের কথাও ভেবেছিলেন হ্যামিল্টন। গবাদিপশু পালন, মাছ চাষ, ফল ও সব্জির বাগান তৈরি, তাঁত চালানো, কাঠের কাজ ও বিভিন্ন কুটিরশিল্পের প্রসারে তিনি উদ্যোগী হন। ১৯০৯-১৯১১ সালের মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় শিক্ষার জন্য অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় তৈরি হয়। প্রতিটি স্কুলের ঘরবাড়ি নির্মাণ, পুকুর খনন ও বাগান তৈরির জন্য ৬-৮ বিঘা জমি দেওয়া হয়। ১৯০৮ সালে গোসাবায় প্রতি সপ্তাহে শনিবার এক দিন হাট চালু করা হয়। এখনও নিয়মিত বসে সেই হাট। ১৯৩২ সালে সমবায় ব্যাঙ্ক চালু করা হয়। সাহেব তাঁর এলাকার জন্য ১ টাকার নোট চালু করেছিলেন। তিনি কৃষি গবেষণাগারও তৈরি করেন। গোসাবার ধান্য গবেষণাগার থেকে উৎপন্ন ২৩ নম্বর পাটনাই ধান বিভিন্ন এলাকায় সুনাম অর্জন করেছিল। কৃষকদের উংসাহিত করার জন্য ১৯২৮ সালে গোসাবায় কৃষি প্রদর্শনীর উদ্বোধন করা হয়। ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলায় ‘রাইস রিসার্চ কনফারেন্স’-এ ব্রিটিশ সরকারের অনুরোধে ভারতীয় প্রতিনিধি হিসাবে হ্যামিল্টন গোসাবার ফার্ম থেকে উৎপাদিত ২৩ নম্বর পাটনাই ধানের কথা বিস্তারিত ভাবে বলেন। জানা যায়, হ্যামিল্টন সাহেবের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ সালের ২৯ ডিসেম্বর (মতান্তরে ৩০ ডিসেম্বর) গোসাবার কর্মযজ্ঞ দেখতে এসেছিলেন। সাহেবের আতিথেয়তায় তিনি দু’দিন বেকন বাংলোতে ছিলেন।

১৯১৬ সালে কৃষি সমবায় সমিতি, ১৯২২ সালে ‘ধান্য বিক্রয় সমবায় সমিতি’ স্থাপন করা হয়। সে সময়ে সমবায় সমিতির রেজিস্ট্রার যামিনীভূষণ মিত্র গোসাবার সমবায় আন্দোলনে যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। তাঁর স্মৃতি রক্ষায় ১৯২৭ সালে ‘যামিনী রাইস মিল’ গড়া হয়।

Advertisement

১৯৩২ সালে ‘গোসাবা রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ইন্সটিটিউশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৩২ সালে ১১ ফেব্রুয়ারি জাঁকজমক সহকারে লেডি মার্গারেট হ্যামিল্টন ওই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পাশ্চাত্যের প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাচ্যে এমন বিশাল কর্মকাণ্ড প্রাচীন গোসাবার চেহারা বদলে দিয়েছিল। এর উদ্দেশ্য ছিল বহুমুখী। নানা বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা হয়েছিল। যার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে-বিদেশেও। হ্যামিল্টন সে যুগে গ্রামোন্নয়নের জন্যে নানা ভাবে চেষ্টা করেছিলেন।

কিন্তু এখন কী হাল হ্যামিল্টন সাহেবের তৈরি করে যাওয়া বিভিন্ন প্রকল্পের? কেমন আছেন গোসাবার চাষি, মৎস্যজীবীরা? কী অবস্থা বৃত্তিমূলক শিক্ষার? কর্মসংস্থানই বা কেমন?

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন