আদিবাসী নাচে মাতল উৎসব প্রাঙ্গণ। রবিবার শান্তনু হালদারের তোলা ছবি।
অসুস্থ শরীরে কেঁদুলি মেলা থেকে সোজা এসেছেন নারায়ণ অধিকারী। রবিবার এই লোকশিল্পীর হাতেই উদ্বোধন হল এ বারের বাণীপুর লোক উৎসব। দোতারা বেঁধে গান ধরলেন তিনি। ‘‘ওরে মানুষ রূপে, এই মানুষ রূপে যুগে যুগে এসেছিলেন ভগবান...’’ বৃদ্ধ শিল্পীর সুরের মূর্চ্ছনায় বাঁধা হয়ে গেল লোক উৎসবের মেজাজটি। নারায়ণবাবু বললেন, ‘‘এখানে এসে মনে হচ্ছে, জীবন ধন্য হয়ে গেল।’’
উৎসবের আড়ম্বর এবং উষ্ণতায় মুদ্ধ মন্ত্রী সাধন পাণ্ডেও। তিনি বললেন, ‘‘বাণীপুর লোক উৎসবের কথা বহু শুনেছি। এখানে এসে বুঝতে পারলাম, এ হল প্রকৃতই লোকশিল্পের পীঠস্থান।’’ পাশে তখন খাদ্যমন্ত্রী তথা স্থানীয় বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক।
গত বস্তুত, গত কয়েক বছর ধরেই বাণীপুরের এই মেলার নাম ছড়িয়েছে দূরদূরান্তে। যা নিয়ে স্থানীয় মানুষের গর্বের অন্ত নেই। উৎসব কমিটির সভাপতি তথা হাবরার পুরপ্রধান নীলিমেশ দাস তো বলেই ফেললেন, ‘‘গোটা রাজ্যে বাণীপুর লোক উৎসবের জনপ্রিয়তা এখন শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার মতোই।’’
এ দিন দুপুরে হাবরা অ্যাথলেটিক ক্লাবের মাঠ থেকে একটি শোভাযাত্রা বের হয় উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে। তাতে কয়েক হাজার স্কুল পড়ুয়া, বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা পা মেলান। গোটা শহর ঘুরে শোভাযাত্রা শেষ হয় উৎসবের মাঠে। সে জন্য অবশ্য এ দিন শহরে বাড়তি যানজটও হয়েছে। তবে অসংখ্য মানুষ রাস্তার দু’ধারে দাঁড়িয়ে বর্ণময় সেই শোভাযাত্রা দেখে আনন্দ কুড়িয়েছেন। যশোর রোডে দাঁড়ানো গাড়ি থেকেও মুখ বেরিয়ে এসে চোখ বুলিয়ে নিয়েছে বিশাল সেই শোভাযাত্রায়।
উৎসব চলবে ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত। তবে ৬২ বছরের এই উৎসবে এ বার একটি নিয়মের ব্যতিক্রম হল। ফেব্রুয়ারির প্রথম রবিবার শুরু হয় উৎসব। চলে পরের বরিবার পর্যন্ত। উদ্যোক্তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের কথা ভেবে এ বার লোক উৎসব এগিয়ে আনা হয়েছে। পরের বছর থেকে ফের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই উৎসব চলবে। দিনক্ষণ পাল্টানোয় কিছু প্রবীণ মানুষ অবশ্যই হতাশ।
শোভাযাত্রায় ছৌশিল্পীরা। রবিবার শান্তনু হালদারের তোলা ছবি।
উৎসবে মোট চারটি মঞ্চ করা হয়েছে। যেগুলি প্রয়াত ব্যক্তিদের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। এঁরা হলেন, যাত্রাশিল্পী ইন্দ্র লাহিড়ি, অভিনেতা পীযূষ গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যিক সুচিত্রা ভট্টচার্য ও সঙ্গীতশিল্পী সুবীর সেন। উৎসবের বিভিন্ন দিনে থাকছে, ঝুমুর, ছৌ, কবিগান, যাত্রা, ভাঁড়যাত্রা, লোকনাট্য, বারোমাস্যা, মতুয়া গান, লেটো, বোলান গান, নাটক, পথনাটিকা, গম্ভীরা, ম্যাজিক শো, রামায়ণ, টকিংডল। বিকেল ৩টে থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত উৎসব চলবে। কুসংস্কার বিরোধী বিজ্ঞান বিষষক প্রদশর্নীর ব্যবস্থা রয়েছে। পটের গান পরিবেশন করবেন স্বর্ণ চিত্রকর, নূরজাহান চিত্রকর, জামেরা চিত্রকরের মতো শিল্পীরা। উৎসবে গেলেই দেখা মিলবে বিখ্যাত বহুরূপী সুবলদাস বৈরাগ্যের। বেণীপুতুল নাচ পরিবেশন করবেন রামপদ ঘড়ুই। বাউল সঙ্গীত পরিবেশনে থাকছেন মনসুর ফকির, অজুর্ন ক্ষ্যাপা, আব্বাস ফকিরেরা।
লোকসংস্কৃতির পাশাপাশি লোকক্রীড়াকেও তুলে ধরা হয় উৎসবে। ভলিবল, ফুটবল, কাবাডি, দড়ি টানাটানির মতো নানা খেলার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকছে। বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির হয়েছে।
যাদবপুর থেকে এ দিন মেয়েকে নিয়ে উৎসবে এসেছিলেন শর্মিষ্ঠা ভট্টচার্য। বললেন, ‘‘কত শুনেছিলাম এই লোক উৎসবের কথা। এখানে না এলে লোকসংস্কৃতি যে এখনও এমন দাপটের সঙ্গে বেঁচে আছে, তা জানতেই পারতাম না।’’
আদিবাসী মৎস্যজীবীদের মধ্যে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। প্রতিযোগীদের হাতে ছাগল, মুরগি, হাঁস, জ্যান্ত মাছ তুলে দেওয়া হয়। জ্যোতিপ্রিয়বাবু বলেন, ‘‘লোকসংস্কৃতির সার্বিক প্রসারে উৎসব কমিটির আন্তরিক প্রয়াস লোকসংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করছে। মানুষের সুস্থ চেতনা প্রসারেও বাণীপুর লোক উৎসব সফল।’’
অমৃতা চট্টোপাধ্যায় নামে এক তরুণী কথায়, ‘‘বাণীপুর লোক উৎসব আমাদের কাছে বার্ষিক পার্বণের মতো। বছরভর আমরা এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করে থাকি। বাইরের দুনিয়ার কাছে হাবরাকে পরিচিতি দিয়েছে এই উৎসব।’’