বিরোধীরা মনোনয়নপত্র জমা দিতে না পারায় নির্বাচনের আগেই জেলার বেশিরভাগ কলেজে জয়ী হয়ে গেল তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। তবে শাসক দলের ছাত্র সংগঠনের এই জয়কে গুরুত্ব দিতে নারাজ বিরোধী এবিভিপি, এসএফআই ও ছাত্র পরিষদ নেতারা। তাঁদের দাবি, পুলিশ-প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে গুলি-বোমা ছুড়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে টিএমসিপি অধিকাংশ কলেজে অন্য কাউকে মনোনয়নপত্রই তুলতে দেয়নি। ফলে একে আর যা-ই হোক, ‘গণতন্ত্রের জয়’ বলা চলে না। অন্য দিকে, জয়ের আনন্দে মাতোয়ারা টিএমসিপি শিবিরের বক্তব্য, বিরোধীরা প্রার্থী দিতে না পারায় জেলার ৩৭টি কলেজে তারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে। প্রার্থী জোগাড়ে ব্যর্থ হয়েই এখন বিরোধীরা ভুল বকছে।
গত তিন দিন ধরে কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র তোলা এবং জমা দেওয়ার কথা ছিল। শনিবার ছিল শেষ দিন। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়সীমা পার হওয়ার পরে দেখা যায়, বেশিরভাগ কলেজে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ ছাড়া বিরোধীদের কেউ মনোনয়নপত্রই জমা দেয়নি। বিরোধীদের অভিযোগ, বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র দেওয়া শুরুর পর থেকে একের পর এক কলেজের বাইরে শাসক দলের সমর্থকদের সঙ্গে কোথাও এসএফআই কোথাও এবিভিপি আবার কোথাও ছাত্র পরিষদের সমর্থকদের মধ্যে তুমুল গণ্ডগোল বাধে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গোলমালের শরিক টিএমসিপি ও এবিভিপি। সন্দেশখালির কালীনগর কলেজের বাইরে তো তিন দিন ধরে বোমা-গুলির শব্দে কান পাতাই দায় হয়েছিল। এমন সন্ত্রাসের কারণে ছাত্রছাত্রীরা আর কলেজে গিয়ে মনোনয়নপত্র তুলতে সাহস করেননি বলে অভিযোগ। বোমা-বন্দুক নিয়ে প্রকাশ্যে দাপাদাপি চলেছে মিনাখাঁর বামনপুকুর হুমায়ুন কবীর কলেজের বাইরে। শুক্রবার ওই কলেজে দু’পক্ষের সমর্থকদের মধ্যে ব্যাপক বোমা-গুলির লড়াই হয়। পুলিশের ৩টি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। বোমার স্প্লিন্টারে জখম হন দুই পুলিশকর্মী। এক পুলিশকর্মীকে অপহরণের চেষ্টাও করা হয়। পুলিশের রিভলভার কেড়ে নেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর হয়। সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে সাংবাদিকদের লক্ষ করে বোমা ছোড়া হয় বলেও অভিযোগ। ছাত্র পরিষদ নেতা রাজীব বিশ্বাস বলেন, “মিনাখাঁ ও সন্দেশখালিতে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা গুলি-বোমা ছুড়ে সন্ত্রাস করেছে। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের পক্ষে এই নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।”
স্বরূপনগরের তেঁতুলিয়ায় শহিদ নুরুল ইসলাম কলেজে মনোনয়নপত্র তোলা কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মারামারির প্রতিবাদে এসএফআই পর পর দু’দিন পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখায়। তাদের অভিযোগ, তৃণমূলের হামলায় এসএফআই ছাত্রেরা কলেজের ভিতরে ঢুকতে পারেননি। দলীয় সমর্থক ছাত্রছাত্রীকে মারধর করা হচ্ছে দেখে নেতৃত্বেরা এলে তাঁদেরও মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। বারাসাত, বনগাঁ, দেগঙ্গার বেশির ভাগ কলেজেও প্রায় একই রকম অভিযোগ এসেছে।
তুলনায় অনেকটাই শান্ত ছিল বসিরহাট কলেজ। শনিবার সকাল থেকে এবিভিপির সমর্থকেরা তৈরি হয় মনোনয়নপত্র জমা দিতে যাবে বলে। এসএফআইয়ের তরফেও বসিরহাট কলেজে যাওয়ার কথা বলা হয়। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসএফআই কিংবা এবিভিপি কোনও পক্ষ কলেজে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখয়নি। কেন শহরের কলেজে যাওয়া যাচ্ছে না, তা নিয়ে দলীয় নেতাদের সঙ্গে এসএফআই ছাত্রনেতাদের মনোমালিন্যের মতো ঘটনারও সাক্ষী হতে হয় দলীয় সমর্থকদের। বসিরহাট দক্ষিণ কেন্দ্রের বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য সে দিন শহরে থাকলেও কেন বিজেপির ছাত্র সংগঠন কলেজমুখী হল না, তা নিয়েও দলের অন্দরে প্রশ্ন দেখা দেয়।
এই বিষয়ে বিজেপি সমর্থিত এভিবিপি-র জেলা সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক বলেছেন, “কলেজ কর্তৃপক্ষ, তৃণমূলের গুন্ডা বাহিনীর সন্ত্রাস এবং পুলিশের উদাসীনতার জন্য আমাদের ছেলেরা বেশির ভাগ কলেজে মনোনয়নপত্র তোলা কিংবা জমা দিতে পারেননি। তা ছাড়া, কলেজের বাইরে বহিরাগতদের নিয়ে যে ভাবে তৃণমূল ছাত্রপরিষদ সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল, তাতে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় ছাত্রছাত্রীদের কলেজে পাঠানোর ঝুঁকি নেওয়া হয়নি।” দলীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে সর্বত্র তৃণমূল ছাত্রপরিষদ জোর করে ছাত্র সংসদ দখল করেছে বলে দাবি করে এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক অয়ন বসু বলেন, “জোর করে ছাত্র সংসদ দখলের ঘটনা যে সত্যি, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ মিনাখাঁ, সন্দেশখালি এবং স্বরূপনগর কলেজ। ব্যারাকপুর থেকে দুষ্কৃতী নিয়ে এসে বারাসতে কলেজ দখল করা হয়েছে।”
অভিযোগ মানতে নারাজ শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। তাদের দাবি, রাজ্যে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে কলেজে পড়ার পরিবেশ ফিরেছে। সে কারণেই ছাত্রছাত্রীরা টিএমসিপিকে পছন্দ করছে। জেলার ৩৭টি কলেজেই তারা জয়ী হয়েছেন বলে দাবি করে জেলা তৃণমূল ছাত্র পরিষদের নির্বাচন কমিটির চেয়ারম্যান সঞ্জয় রাহা বলেন, “আমাদের জয় বিরোধীরা সহ্য করতে পারছে না। বিরোধীরা মনোনয়নপত্র তুলতে দেওয়া হয়নি বলে যে নালিশ করছে, তা মিথ্যা। কারণ, ফর্ম তো অনলাইনেও তোলা যাচ্ছিল। আসলে প্রার্থী জোগাড় করতে না পেরে এখন ওরা মিথ্যা অভিযোগ করছে।”
কলেজ কর্তৃপক্ষ, তৃণমূলের সন্ত্রাস ও পুলিশি উদাসীনতায় আমরা
বহু কলেজে মনোনয়ন তোলা বা জমা দিতে পারিনি। বহিরাগতদের
নিয়ে টিএমসিপি সন্ত্রাস সৃষ্টি করায় দলীয় ছাত্রছাত্রীদের কলেজে পাঠানোর ঝুঁকি নেওয়া হয়নি।”
অচিন্ত্য মল্লিক। এবিভিপি নেতা
আমাদের জয় বিরোধীরা সহ্য করতে পারছে না। বিরোধীরা মনোনয়ন তুলতে দেওয়া হয়নি বলে যে অভিযোগ করছে, তা মিথ্যা। কারণ,
ফর্ম অনলাইনে তোলা যাচ্ছিল। প্রার্থী জোগাড় করতে না
পেরে এখন ওরা মিথ্যা অভিযোগ করছে।”
সঞ্জয় রাহা। টিএমসিপি নেতা