উথালপাথাল ঢেউয়ের খেয়ালে টালমাটাল দশায় একটা কথাই বার বার চিত্কার করে বলছিলেন ‘দীপক স্যার’ ‘হাত ধরে থাক সকলে, একা-একা একদম পাকামি করতে যাবি না!’
খিদিরপুর বাবুবাজারের কোচিং ক্লাসের প্রিয় শিক্ষকের এই শেষ কথাটা এখনও কানে বাজছে সঞ্জয় ধানুক ও সামান ধানুকের। একবালপুরের ময়ূরভঞ্জ রোডের বাড়িতে বসে শনিবার বিকেলেও প্রায় কাঁপছিলেন উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী দুই তরুণ। শুক্রবার দুপুরে বকখালিতে সমুদ্রের তাণ্ডব-লীলার সাক্ষী এই দুই ছাত্র। নিজেরা কোনও মতে প্রাণ হাতে করে পাড়ে উঠে আসতে পেরেছে। কিন্তু প্রিয় ‘দীপক স্যার’ ও তিন সতীর্থকে প্রায় চোখের সামনে ঢেউয়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে দেখে তারা। দুর্ঘটনার এক দিন বাদেও আতঙ্কের ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি কেউ।
এ দিকে, শনিবার দিনভর তল্লাশি চালিয়েও তিন ছাত্র অভিষেক ধানুক, চন্দন গুপ্ত ও ফৈজল খানদের খোঁজ মেলেনি। তারা সমুদ্রের গ্রাস থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে কি না, তা স্পষ্ট নয়। তবে শুক্রবার রাতেই শিক্ষক দীপককুমার বাল্মীকির (৩০) দেহ উদ্ধার করে পুলিশ। খিদিরপুর অঞ্চলের একটি কোচিং ক্লাসের জনপ্রিয় শিক্ষক দীপকবাবুর সঙ্গে প্রতি বছরের মতো এ বারও বকখালিতে বেড়াতে যান জনা ৪০ পড়ুয়া। নতুন বছরের গোড়ায় এমন অঘটনের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না ওই এলাকা।
ময়ূরভঞ্জ রোডেই কাছাকাছি বাড়ি সঞ্জয় ও সামানের। সঞ্জয় জানাল, প্রথমে সমুদ্রের চেহারা দেখে এমন ভয়াল মেজাজ আঁচ করতে পারেনি তারা। বকখালিতে বালিয়াড়ি ধরে এগিয়ে জল অবধি পৌঁছতে বেশ খানিকটা হাঁটতে হয়। ভাটার সময়ে সমুদ্রে নেমে বুঝতে ভুল করেই বেশ খানিকটা ভিতরে চলে যায় তারা। সঞ্জয়-সামানদের মনে আছে, জোয়ার শুরুর পরে সমুদ্রের অবস্থা দেখে ‘স্যার’ বলেছিলেন, সাবধানে সবাই মিলে হাতে হাত ধরে এগোতে। দীপকবাবু, অভিষেক, চন্দন, ফৈজলদের সঙ্গে হাতে হাত ধরেই এগোচ্ছিল সঞ্জয়, সামান ও ইমরান খান নামে এক সতীর্থ। কিন্তু ঢেউয়ের প্রবল তোড়ে হাত ছেড়ে ছিটকে যায় তারা। সঞ্জয়, সামান ও ইমরান পাড়ে পৌঁছেও দেখতে পাচ্ছিল বাকিদের। ঢেউয়ের মধ্যে দু’হাত তুলে হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বাঁচার চেষ্টা করছিল বাকিরা। তা দেখে ইমরান জলে ঝাঁপিয়ে বাকিদের উদ্ধারের চেষ্টা করলেও লাভ হয়নি। স্থানীয় বিধায়ক ফিরহাদ হাকিমের সাহায্যে তাদের কলকাতায় ফেরানোর ব্যবস্থা হয়। এ দিন ইমরানের সঙ্গে কথা বলা না গেলেও সামান বার বার বলছিল, “দীপক স্যার আমাদের স্যার, দাদা, বন্ধু সবই ছিলেন। গত বারও ওঁর সঙ্গে দিঘা বেড়াতে যাই। কী করে বুঝব, এ বার এমন ঘটবে।”
বকখালিতে পর্যটকদের সতর্ক করতে মাইকে লাগাতার প্রচার চলছিল বলে দাবি স্থানীয় প্রশাসনের। তবু সতর্কতা পর্যাপ্ত ছিল না বলে প্রশাসনকেই দুষছেন নিখোঁজ ছাত্রদের পরিজনেরা। ফৈজল খানের দাদা রাকেশ ভাইয়ের খোঁজে বকখালিতে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, “আমার ভাই, অভিষেক, চন্দনরা কেউ সাঁতার জানত না। সমুদ্রে ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। বকখালির সমুদ্রের ধরন নিয়ে ওদের সতর্ক করার কেউ ছিল না।” এ দিন ময়ূরভঞ্জ রোডের কাছে অভিষেক, চন্দনদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায় থমথমে পরিবেশ। অভিষেক বাড়ির সবার ছোট। আগে কখনও মা-বাবাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। বর্নফিল্ড রোয়ের ফৈজলের বাবা গিয়েছেন ছেলের খোঁজে। বাড়িতে মা একা রয়েছেন। শোকে কথা বলতে পারছেন না তিনি।