বনগাঁর চাঁদার হাটের সব্জির জোগান যায় ভিন্ রাজ্যেও

শুরুটা হয়েছিল প্রায় ষাট বছর আগে। দিনে দিনে রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বনগাঁর চাঁদার হাটের সুনাম ছড়িয়েছে ভিন্ রাজ্যেও। এই হাট থেকে সব্জি চলে যাচ্ছে মুম্বই, দিল্লি, উড়িষ্যা, বিহার-সহ দেশের নানা প্রান্তে। একটা সময় ছিল গরুর গাড়ি বোঝাই করে চাষিরা হাটে সব্জি-সহ নানা মালপত্র নিয়ে আসতেন। যারা গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারতেন না, তারা হেঁটে মাথায় করে মালপত্র নিয়ে আসতেন। এখন অবশ্য চাষিরা খেত থেকে ম্যাটাডর ভ্যান বা লরিতে করে সব্জি নিয়ে হাটে আসছেন।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩৪
Share:

চলছে বেচাকেনা। চাঁদার হাটে তোলা নিজস্ব চিত্র।

শুরুটা হয়েছিল প্রায় ষাট বছর আগে। দিনে দিনে রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বনগাঁর চাঁদার হাটের সুনাম ছড়িয়েছে ভিন্ রাজ্যেও। এই হাট থেকে সব্জি চলে যাচ্ছে মুম্বই, দিল্লি, উড়িষ্যা, বিহার-সহ দেশের নানা প্রান্তে। একটা সময় ছিল গরুর গাড়ি বোঝাই করে চাষিরা হাটে সব্জি-সহ নানা মালপত্র নিয়ে আসতেন। যারা গরুর গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারতেন না, তারা হেঁটে মাথায় করে মালপত্র নিয়ে আসতেন। এখন অবশ্য চাষিরা খেত থেকে ম্যাটাডর ভ্যান বা লরিতে করে সব্জি নিয়ে হাটে আসছেন। হাটে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় সভাইপুর, পানচিতা, নকফুল, মাধবপুর, গাঁড়াপোতা প্রভৃতি এলাকা থেকে চাষিরা দলে দলে হাটে মালপত্র নিয়ে এসেছেন। হাটের একপাশ দিয়ে চলে গিয়েছে বেদিয়াপোতা রোড। সার দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সব্জি বোঝাই গাড়ি। হাজারেরও বেশি চাষি এখানে আসেন ফসল বিক্রি করতে। বাঁশের খুঁটি ও টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট ছোট ঘরে পাঁচশোরও বেশি দোকান।

Advertisement

বনগাঁ-বাগদা সড়কের পাশে প্রায় ছয় বিঘা জমির উপর প্রতি সপ্তাহের বুধ ও শনিবার হাট বসে। হাটটির মালিক সুরেশ বিশ্বাস, বিপ্লব বিশ্বাসেরা বলেন, ‘‘অতীতে নকফুল এলাকায় হাট বসত। ১৯৫৭ সাল থেকে চাঁদা এলাকায় হাটটি বসছে। স্থানীয় বাসিন্দা অটলচন্দ্র বিশ্বাস ও মহেন্দ্রনাথ বিশ্বাস এই হাটের সূচনা করেন। হাটের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় সরকারি লাইসেন্স আছে। বাণিজ্য কর তাঁরা দেন। হাটের পরিকাঠামো উন্নয়নে সরকার আজ পর্যন্ত উদ্যোগী হয়নি। পরিকাঠামো তৈরি করেছেন হাটের মালিক ও ব্যবসায়ীরা।” হাট উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে জানা গিয়েছে, ভোর সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ১২টা মূলত পাইকারি হাট বসে। দুপুরের পর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত চলে খুচরো কেনাবেচা।

বছর ষাটের বৃদ্ধ সুরথ দত্ত প্রায় ৪৩ বছর ধরে হাটে গুড় বিক্রি করছেন। তাঁর বাড়ি স্থানীয় গোবরাপুর গ্রামে। জানালেন, সপ্তাহে দু’দিনের জন্য হাট মালিককে দিতে হয় পাঁচ টাকা। বড় দোকান হলে দিতে হয় ১০ টাকা। তিনিন বললেন, “বনগাঁ থেকে গুড় এনে বিক্রি করি। এখানে সব কিছুর ব্যবস্থা আছে।’’ চল্লিশ বছর ধরে হাটে কাস্তে, দা, হাতুড়ি বিক্রি করছেন পঁয়ষট্টি বছরের নিমাই কর্মকার। বাড়ি ধর্মপুকুরিয়া গ্রামে। তিনি জানালেন, বাড়িতেই জিনিস তৈরি করে সাইকেলে করে হাটে এনে বিক্রি করেন। দীর্ঘ দিনের যাওয়া আসার ফলে হাটের অতীত-বর্তমান সবই দেখেছেন তিনি। বললেন, “অতীতে লম্ফ, কুপি ও হ্যারিকেনের আলো জ্বেলে বেচা-কেনা করতে হত। সন্ধের পরেই বাড়ি ফিরতে হত। এখন বিদ্যুতের আলো হয়েছে। এখন রাত পর্যন্ত থাকি।’’ বছরের সব সময়ে বিক্রি বাটা এক রকম থাকে না। জানালেন, ‘‘পাট কাটার সময় ও ধান কাটার সময় বিক্রি ভাল হয়।’’ হাটে কুড়ি বছর ধরে বীজের দোকান দিয়ে আসছেন পানচিতা গ্রামের কালাচাঁদ হাওলাদার। কালাচাঁদ বলেন, “প্রথম যখন দোকান দিই, এক কিলোগ্রাম ওলকপি বীজের দাম ছিল ২৫ টাকা। এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে পাঁচশো টাকা। ফলে অনেক চাষি নিজেরাই জমিতে বীজ তৈরি করছেন। বীজ বিক্রি আগের থেকে কমেছে।” আছে চালের হাটও। বছর বাহাত্তরের বৃদ্ধ চিত্তরঞ্জন সাহার বাড়িতে কুঠিয়ালি রয়েছে। ধান কিনে চাল তৈরি করে হাটে বিক্রি করেন তিনি। জানালেন, “এক হাটে ৫০ কিলোগ্রামের মতো চাল বিক্রি হয়। এক হাটে চাল বিক্রি করে পরের হাটে অনেকে টাকা পরিশোধ করেন। গ্রামের গরিব মানুষও এখানে আসেন। তাদের সুবিধা অসুবিধা দেখতে হয়।”

Advertisement

হাটের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে স্থানীয় মানুষের জীবিকার সম্ভাবনাও। খেত থেকে চাষির ফসল ভ্যানে করে হাটে আনা-নেওয়ার কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেকে। তাদেরই একজন নারায়ণ মণ্ডল বলেন, “ইঞ্জিন ভ্যানে যাত্রীরা বেশি ওঠেন না। প্রতি হাটে ফসল আনা নেওয়া করে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা আয় করছি। সংসার ভালভাবেই চলে যাচ্ছে। আমাদের কাছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ওই হাট।”

তবে পরিকাঠামোর কিছু সমস্যা এখনও রয়ে গিয়েছে। বৃষ্টিতে কাদায় ভরে যায় হাট চত্বর। জলও দাঁড়িয়ে যায়। তবে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই ইট পেতে মাটি ফেলে এলাকা উঁচু করে নিয়েছেন। এখন বৃষ্টি হলেও কাদা কম হচ্ছে। জল মাঠের দিকে চলে যায়। বহু বছর ধরে হাটে কেনাকাটা করছেন বৃদ্ধ অসিত মণ্ডল। তিনি বললেন, “ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে হাটে আসতাম। দেখতাম, ফসল বিক্রি না হলে চাষিরা তা হাটেই ফেলে রেখে চলে যেতেন। অনেক গরিব মানুষ তা কুড়িয়ে নিয়ে যেতেন। আর এখন, একটা পটল, বেগুনও পড়ে থাকতে দেখা যায় না।” টাটকা সব্জির টানেও বহু মানুষ দূর-দূরান্ত থেকেও ভিড় জমান এখানে। কারও আবার হাটে এসে বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব না করলে ভাল লাগে না। তাই সাপ্তাহিক আড্ডার দিনও এই হাটবার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement