ক’দিন বাদেই সেজে উঠবে দেবীমূর্তি। —নিজস্ব চিত্র।
পরিবারের নতুন প্রজন্মের মতামতকে গুরুত্ব না দিয়ে আর উপায় থাকছে না। আর তাই শতাব্দী প্রাচীন পুজোর আচার-অনুষ্ঠানেও অনেক বদল আসছে কামারপোলের বসুবাড়িতে। তাতে পুরনো প্রজন্মের খুঁতখুঁতানি বিস্তর। কিন্তু বজ্র আঁটুনি দিয়ে নতুন হাওয়াকে আর এড়ানো যাচ্ছে কই!
বসুবাড়ির পুজো এ বার পড়ল ২৪৫ বছরে। এ বারই প্রথম বার পাঁঠাবলির রীতি থেকে সরে আসছেন তাঁরা। ‘‘অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার প্রতীক হিসেবে পাঁঠাবলির রীতি এত দিন আমরা পালন করে এসেছি। কিন্তু আমাদের মতো আরও বেশ কয়েকজনের মনে হয়েছে, এই রীতি বজায় রাখতে গিয়ে কতগুলি নিরীহ প্রাণীকে হাঁড়িকাঠের সামনে দাঁড় করানো যায় না’’— বলছিলেন প্রিয়ম বসু। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে বি টেক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র প্রিয়ম পরিবারের নতুন প্রজন্মের মুখ। জ্ঞাতিদের নিয়ে গঠিত প্রায় ১০০ সদস্যের ‘শ্রীধর জিউ ট্রাস্ট’-এর বেশিরভাগ সদস্যই এ বার প্রিতমের মতোই বলির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন বলে দাবি করছেন তাঁরা।
নিয়মকানুনের বেড়াজাল এ বার একটু হালকা করে দিতে চান অধিকাংশই। ট্রাস্টের সম্পাদক রঘুনাথ বসু এমনই দাবি করে বললেন কথায়, ‘‘বলিটা আর ভাল লাগছে না অনেকেরই। তা ছাড়াও, প্রচুর এমন নিয়ম-কানুন রয়েছে, যা হয় তো এখনকার পুরোহিতেরাও অনেকে ভাল মতো বোঝেন না।’’ ঠিক হয়েছে, ষষ্ঠী থেকে শুরু করে নবমীর রাত পর্যন্ত ৫টি পাঁঠার বলি আর হবে না।
কামারপোলের জমিদার বাড়ির ইতিহাস বলছে, বংশের আদি পুরুষ গদাধর বসুর বড় ছেলে অভিরাম বসুই কামারপোলে প্রথম দুর্গাপুজো শুরু করেন। সেটা ১৭৭০ সালের কথা। বসু বংশের উত্তরাধিকারীরা ছাড়াও পটুয়া, ঢাকি, প্রতিমা শিল্পীরাও বংশ পরম্পরায় এই পুজোয় কাজ করে আসছেন। একচালার দেবীপ্রতিমা পূজিত হন প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
এ বার ঠিক হয়েছে, ষড়রিপুর প্রতীক চালের পুতুল বলি দেওয়াও বন্ধ। কুলপুরোহিত প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘কাম, ক্রোধ, বাসনার মতো কিছু শক্তি, যা সকলের ভেতরেই কমবেশি থাকে, সেগুলিকেই চালের পুতুলের মাধ্যমে বলি দেওয়া হয়। এ বার থেকে তা-ও আর থাকছে না বলে জানিয়েছেন ট্রাস্টিরা।’’ চালকুমড়ো, আখ বলিও এ বার থেকে উঠে যাচ্ছে। এ সবের বদলে বরং আলোকসজ্জা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপরে জোর দিতে আগ্রহী তরুণ প্রজন্ম। নাটমন্দির-লাগোয়া মঞ্চে পুজোর ক’দিন বসবে গান, নাচ, আবৃত্তির আসর।
তেরো দিন ধরে বোধন হতো এই বাড়ির পুজোয়। বোধনের সেই রীতিও বদলে একদিনের বোধন চালু হচ্ছে এ বছর থেকে। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের সময়ে একবার নৈবেদ্যর চাল কমিয়ে দিতে হয়েছিল। তখন প্রায় ১৩ মন চাল লাগত পুজোর কটা দিন। এখন বরাদ্দ সাড়ে সাত কেজি।
অভিরাম বসুর পরিবার বড় হতে হতে এখন কামারপোলের পুরো একটি পাড়া জুড়ে ছড়িয়েছে। পরিবারের অনেকেই কাজের সূত্রে কলকাতা, এমনকী দেশের বাইরেও থাকেন। ষষ্ঠী থেকেই চলে আসেন সকলে। তবে পুজোর আয়োজনে ততটা উৎসাহ দেখায় না নতুন প্রজন্ম, তা নিয়ে অভিমান আছে প্রবীণদের। অনেকের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, পুজোর রীতি-নীতি বদলে তাঁদের পুরোদস্তুর সায় নেই। পরিবারের বর্ষীয়ান সদস্য বরুণ বসু বলেন, ‘‘এ রকম একটা পদক্ষেপ হঠাৎ করে নিলে হয় তো ক্ষতি হবে পরিবারের, বসুপাড়ার।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কেন এত দিনের একটা ঐতিহ্য বাতিল করে ফেলতে হবে? পূর্বপুরুষদের সযত্নে রক্ষিত এই রীতি আমরা ভাঙতে পারি? এটা গড়তে কিন্তু দীর্ঘ সময় লেগেছে।’’
কিন্তু কালের নিয়মে কত কী তো বদলাচ্ছে, যুক্তি দিচ্ছেন নবীনেরা। আর তাঁদের যুক্তিকে এক কথায় উড়িয়ে দেওয়াও যাচ্ছে না। ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে নতুন করে তৈরি করানো হয়েছিল বলির খাঁড়া। এ বার সেটি তাই পাকাপাকি ভাবে কোনও এক শরিক বাড়ির দেওয়ালে জায়গা করে নিতে চলেছে।