নামখানা বন্দর থেকে বার্জে করে বড় গাড়ি হাতানিয়া-দোয়ানিয়া পার হতে পারছে না মাস দেড়েক ধরে। কারণ, মেরামতির কাজ চলছে। কিন্তু তার জেরে নামখানা এবং বকখালির পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। পেট্রল-ডিজেলের চড়া দাম প্রভাব ফেলেছে পর্যটন, পান ব্যবসা থেকে শুরু করে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে।
বার্জ ঘাটে কংক্রিট জেটি সারানোর কাজ করছে ভূতল পরিবহণ নিগম। সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর নীলাঞ্জন শান্ডিল্য জানিয়েছেন, দীর্ঘ দিন ধরে জেটি মেরামত হয়নি। ভূতল পরিবহণ নিগম সম্প্রতি দায়িত্ব পাওয়ার পরে কয়েকটি পর্যায়ে জেটি, গ্যাংওয়ে এবং গার্ডার সারাইয়ের কাজ করেছে। সোমবার পরীক্ষামূলক ভাবে কিছু বড় গাড়িও চালানো হয়েছে। তবে যান চলাচল পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে। কাকদ্বীপের মহকুমাশাসক অমিথ নাথ বলেন, “আশা করছি, মঙ্গলবার থেকে সমস্যা অনেকটাই মিটবে।”
মাস দেড়েক ধরে বার্জের এই সমস্যা সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলেছে নদীর ও পাড়ে নামখানা এবং বকখালির পরিবহণ ব্যবস্থায়। নামখানা এবং বকখালির পেট্রল পাম্পগুলি শুকিয়ে গিয়েছে জ্বালানি তেলের অভাবে। ফলে বকখালি, নামখানা, ফ্রেজারগঞ্জ এবং হরিপুর এলাকার বাসিন্দাদের তেল নেওয়ার জন্য নদী পেরিয়ে কাকদ্বীপের দিকে প্রায় ১ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে। ব্যবসায়ীদেরও একই অবস্থা। সুন্দরবন সমবায় পরিবহণ সমিতির সম্পাদক প্রণবকুমার বেরার কথায়, “দূর থেকে ডিজেল আনতে লিটার-পিছু ২ টাকা বেশি খরচ পড়ে যাচ্ছে। তা-ও সব সময়ে পাওয়া যাচ্ছে না।” সমবায় সমিতির একটি পেট্রল পাম্প আছে নামখানা বাজারে। প্রণববাবু জানান, বড় ট্যাঙ্কার আসছে না বলে পাম্প বন্ধ রাখতে হয়েছে।
নামখানা-বকখালি রুটে মোট ২৩টি বাস চলাচল করে। হরিপুর-নামখানা রুটে চলে কম করে ১০০টি অটো। পরিবহণ ব্যবস্থা চালু রাখার জন্য এলাকায় রোজ প্রায় দেড় হাজার লিটার জ্বালানি তেল প্রয়োজন হয়। পেট্রল কেরোসিনেরও একই অবস্থা। নদী পেরিয়ে কাকদ্বীপ বা নারায়ণপুরে এসে তেল নিয়ে ফিরতে পরিবহণ খরচ বেশি পড়ছে। জ্যারিকেনে অল্প অল্প করে তেল বয়ে আনতে হচ্ছে নৌকোয়।
জ্বালানির সমস্যার জন্য এলাকার অন্য সব কিছুর দরের উপরেই কমবেশি প্রভাব পড়েছে। রোজকার আনাজপাতির দর মহকুমা সদর থেকে অনেকটা বেশি। কোনও কোনও এলাকায় আলুর দর কখনও কিলোপ্রতি ২৬ টাকারও বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই পকেট পুড়ছে সাধারণ মানুষের। বাইরে থেকে আসা আনাজপাতির মধ্যে পেঁয়াজের দরও চড়া এলাকায়। মার খেয়েছে নির্মাণ শিল্পও। ঘর-বাড়ি তৈরির ইট-বালি-সিমেন্ট-রড আগে বড় গাড়ি করে আসতে পারত। সে ব্যবস্থা কিছু দিন ধরে শিকেয় ওঠায় নির্মাণ ব্যবসায়ীরাও মাল তোলা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছেন বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেল। কারণ, যে টাকা দিয়ে নারায়ণপুর থেকে নদী পার করে মাল নিয়ে আসতে হচ্ছে, তা বেচে লাভ হচ্ছে না। এলাকায় বিদ্যুদয়নের কাজ চলছে। সে জন্য প্রয়োজনীয় বড় বড় কংক্রিটের খুঁটি পোঁতার কাজও প্রায় মাসখানেক হল বন্ধ।
দ্বারিকনগর এলাকা থেকে কলকাতা এবং কাকদ্বীপে পানের ব্যবসা করেন সিদ্ধার্থ জানা। তাঁর অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। বললেন, “এক তালা (আড়াই থেকে তিন হাজার পানের বান্ডিল) পান কাকদ্বীপে পাঠাতাম ২০ টাকায়। বার্জ খারাপ থাকায় বড় গাড়ি পাঠানো যাচ্ছে না। মেশিন ভ্যানে করে পাঠাতে প্রায় দ্বিগুণ খরচ হচ্ছে।” চাষিরা জানাচ্ছেন, এলাকা থেকে সপ্তাহে প্রায় ১০০ গাড়ি পান কলকাতার দিকে আসত। কিন্তু পরিবহণ খরচ বেড়ে যাওয়ায় মার খাচ্ছেন প্রান্তিক পান চাষিরাও।
বার্জে করে আগে যেমন অনায়াসে লরি থেকে শুরু করে বড় বাস নদী পেরিয়ে যেত, বেশ কিছু দিন ধরে তা বন্ধ। নড়বড়ে কংক্রিট জেটি মেরামতির কাজের জন্য ছোট গাড়ি চলাচলও মাঝে মধ্যেই বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সপ্তাহান্তে পর্যটকও কমছে বলে জানালেন বকখালির হোটের ব্যবসায়ীরা। হোটেল ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্মৃতিকণ্ঠ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “প্রশাসন কবে এই বার্জের সমস্যার উপরে নজর দেবে, তার অপেক্ষায় আছি। একেই এলাকায় সমস্ত জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া। কষ্ট করে হোটেল চালাতে হচ্ছে। পর্যটকদের সমস্যা হলে ব্যবসা চালানো খুবই মুশকিল।” দ্রুত বড় গাড়ি চালানোর দাবিতে নামখানা ও বকখালির ব্যবসায়ী সংগঠনগুলি বিডিও অফিসে স্মারকলিপি দেওয়ার কথাও ভাবছেন বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা।
তবে ভূতল পরিবহণ নিগমের তরফে যে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, তাতে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত এলাকারা মানুষ। তবে যান চলাচল কবে পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়, সে দিকে তাকিয়ে আছেন সকলেই।