মাসোহারা গুনলেই লোকাল ট্রেনের সিট বুকিং

অফিস টাইমের বনগাঁ লোকালে যাতায়াত করতে গিয়ে হেনস্থা হননি, এমন মানুষ হাতে গোনা। নিত্যযাত্রীদের দাদাগিরি আর দুর্ব্যবহার সহ্য করতে হয় তাঁদের। পরিস্থিতি কেমন, খোঁজ নিল আনন্দবাজার।লোকাল ট্রেনে সিট বুকিং! বটেই তো, বনগাঁ লোকাল যে। শুনলে যে কেউ একটু অবাক হবেন। কিন্তু এতটুকুও অবাক হবেন না, যদি সকালের দিকে উঠে পড়েন বনগাঁ লোকালে। নিত্যযাত্রী ও যাঁরা মাঝেমধ্যে বনগাঁ লাইনে ট্রেনে যাতায়াত করেন তাঁদের কাছে এই অভিজ্ঞতা বহু পুরনো।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০১:১৬
Share:

বনগাঁয় প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে ট্রেন দু’টো স্টেশন যাওয়ার পরের দৃশ্য। তখনও খবরের কাগজ পেতে দখলে রাখা হয়েছে সিট। ছবিটি তুলেছেন নির্মাল্য প্রামাণিক।

লোকাল ট্রেনে সিট বুকিং! বটেই তো, বনগাঁ লোকাল যে।

Advertisement

শুনলে যে কেউ একটু অবাক হবেন। কিন্তু এতটুকুও অবাক হবেন না, যদি সকালের দিকে উঠে পড়েন বনগাঁ লোকালে। নিত্যযাত্রী ও যাঁরা মাঝেমধ্যে বনগাঁ লাইনে ট্রেনে যাতায়াত করেন তাঁদের কাছে এই অভিজ্ঞতা বহু পুরনো। নিত্যযাত্রীদের কয়েক জনের কাছেই জানা গেল, সিট বুকিংয়ের কায়দাকানুন। তাঁদের কথায়, “আগেভাগে জায়গা দখলে রাখতে রীতিমতো মাসোহারা দিয়ে লোক রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। তারাই স্টেশনে ট্রেন ঢুকলেই লাফিয়ে উঠে আগেই জায়গা দখল করে রেখে দেয়। পরে সময় নিয়ে ধীরেসুস্থে এসে জায়গা নেন অফিসবাবুরা।” জায়গা রাখার পদ্ধতিতে রয়েছে চমক। কখনও সিগারেটের প্যাকেট, চিরুনি, খবরের কাগজ, রুমাল, দেশলাই এমনকী দেশলাই কাঠি দিয়েও চলে বুকিং! ভুল করে আগের কোনও যাত্রী সে সব ফেলে গিয়েছে ভেবে তা সরিয়ে বসতে গেলেই নিমেষে ভুল ভাঙতে বাধ্য। সঙ্গে সঙ্গে ধেয়ে আসবে নিত্যযাত্রীদের কটূক্তি, অশ্লীল মন্তব্য, এমনকী হুমকিও। মানে মানে জায়গা ছেড়ে নিজের সম্মান বাঁচাতে হবে নতুন যাত্রীটিকে।

সিট বুকিংয়ের কায়দা সরেজমিন দেখতে সাতসকালে হাজির হওয়া গিয়েছিল বনগাঁ স্টেশনে। ঘড়িতে সকাল ৭টা ২০ মিনিট। ২ নম্বর প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে বনগাঁ-মাঝেরহাট লোকাল। যাত্রীরা অনেকেই ট্রেনে উঠে পড়েছেন। ট্রেনের কয়েকটা কামরা ঘুরে দেখা গেল, যাত্রী নেই। অথচ সিটে পড়ে রয়েছে খবরের কাগজ, সিগারেটের প্যাকেট, কাগজের ঠোঙা। যাত্রীদের অনেকে সে সব এড়িয়েই বসার জায়গা খুঁজতে ব্যস্ত। একটি কামরায় দেখা গেল এক দিকের সমস্ত সিট জুড়ে খবরের কাগজ রাখা। তাকিয়ে থাকতে দেখে উল্টো দিকের এক যাত্রীর মন্তব্য, ‘ওটা গ্রুপ বুকিং’।

Advertisement

এরই মধ্যে ৭টা ২৫ মিনিট নাগাদ কারশেড থেকে ট্রেন ঢুকতে দেখা গেল ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। ঘোষণায় জানা গেল, সেটি শিয়ালদহ যাবে। ট্রেন প্ল্যাটফর্মে থামতেই এক যুবক হাতে বেশ কিছু রুমাল নিয়ে কামরায় ঢুকে পড়ল। তার পিছু নিয়ে দেখা গেল, জানালার ধারের সিটগুলোতে পর পর রুমালগু রেখে দ্রুত ট্রেন থেকে নেমেও পড়ল। সঙ্গী চিত্রসাংবাদিক ছবি তুলতে গেলে যুবকের অনুরোধ, “আমার ছবিটা তুলবেন না।” যুবকটি চলে যেতে না যেতেই এক ব্যক্তি গোটা দশেক খবরের কাগজ নিয়ে কামরায় উঠে একই ভাবে সিটের উপর রেখে নেমে গেল। ঘড়িতে ৭টা ৩২ মিনিট। ২ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছেড়ে যাচ্ছে বনগাঁ-মাঝেরহাট লোকাল। ছুটে গিয়ে জানালায় উঁকি মারতেই দেখা গেল, তখনও কয়েকটি সিটে কাগজের টুকরো পড়ে রয়েছে। অথচ যাত্রী নেই। এক নিত্যযাত্রী জানালেন, ওগুলোর বুকিং চাঁদপাড়া বা ঠাকুরনগর থেকে। ওখান থেকেই লোক উঠবে।

ফের ফিরে আসা ৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মে। তখনও ছাড়েনি শিয়ালদহ লোকাল। একটা কামরায় উঠতেই চোখে পড়ল খবরের কাগজের পাতা দিয়ে জানালার ধার-সহ বেশ কিছু সিট বুক করা রয়েছে। যাত্রীরা সেগুলি ছেড়ে বসছেন। কী হয় দেখতে, একটি সিট থেকে কাগজের পাতা সরিয়ে বসতেই এক যাত্রী সাবধান করলেন, “দাদা, ওখানে বসলে ঝামেলা হবে।” বললাম, “ঠিক আছে।” ট্রেন ছাড়ার সময় এগিয়ে আসছে। এক যাত্রী উঠে সিটে কাগজ দেখে জানতে চাইলেন, “দাদা ওখানে কেউ আছেন?” “জানি না” বলায় তিনি অন্যত্র চলে গেলেন।

ঘড়িতে ৭টা ৫৭ মিনিট। হঠাত্‌ই এক যাত্রী কামরায় উঠে সটান এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, কেন বসেছি ওই সিটে। গলায় স্পষ্টতই হুমকি, “কাগজটা কেন সরালেন। দেখেননি সিট রাখা রয়েছে।” ‘সরি’ বলে সরে বসতেই স্বস্তি ফিরল মুখে। ৮টা ০৮ মিনিটে ট্রেন ছাড়তেই দেখা গেল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছেন কেউ কেউ। ট্রেন চাঁদপাড়ায় ঢোকার পরে সেখান থেকেও উঠে বুকিং সিটে বসলে পড়লেন অনেকে। সাধারণ যাত্রীরা অবশ্য দাঁড়িয়েই ছিলেন। কামরায় ভিড় বাড়লেও বসা উপায় নেই।

ট্রেন চাঁদপাড়া ছাড়তেই বসে গেল তাসের আসর। মাঝেমধ্যেই খেলার মধ্যে নানা রকমের চিত্‌কার। অসুবিধা হওয়ায় ‘একটু আস্তে’ বলে অনুরোধ করতেই রীতিমতো মারমুখী চার জন। হাবরায় ঢুকতেই জানলার বাইরে ছুটে এলেন এক চা বিক্রেতা। কাগজের কাপে বাড়িয়ে দিলেন গরম চা। সেই সঙ্গে ভেসে এল মন্তব্য, “ভেন্ডারের পরের কামরায় রাখা আছে লাল রুমাল” যার উদ্দেশে বলা, তিনি তখন সে দিকে পা বাড়িয়েছেন।

হাবরা নেমে ফের বনগাঁয় ফেরার ট্রেন ধরলাম। বনগাঁয় ফিরে দেখা গেল অন্য দৃশ্য। শিয়ালদহগামী ট্রেনের কামরায় যে যার মতো উঠে বসছেন। ফের অবাক হওয়ার পালা। যাত্রীদের কয়েকজন ধোঁয়াশা কাটালেন। জানা গেল, সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত (যা মোটামুটি অফিস টাইম বলেই পরিচিত) সিট বুকিং করা হয়। তারপর থেকে মোটামুটি স্বাভাবিক।

গোবরডাঙা থেকে কলকাতায় মাঝেমধ্যেই যাতায়াত করেন সোমনাথ বিশ্বাস। তাঁর কথায়, “সকালে বনগাঁ লোকালে সিট পাওয়া লটারির পাওয়ার সামিল।” বনগাঁর বাসিন্দা প্রতাপচন্দ্র পাল বললেন, “সকালে বনগাঁয় যেমন, বিকেলে শিয়ালদহ থেকে ফেরার সময়েও একই ভাবে সিট বুকিং চলে।” তাঁর ক্ষোভ, “মনে হয় যেন হয় ওঁদের জন্যই ট্রেন চলছে।” সাধারণ যাত্রীদের অনেকেরই অভিযোগ, রেল পুলিশের সামনেই এমন সিট বুকিং চললেও কারও কোনও হেলদোল দেখা যায় না। অভিযোগ করেও ফল হয় না।

(চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন