শারদোৎসবে বনগাঁর চিরাচরিত সাহিত্য-সাজ

যতই হাঁড়ির হাল হোক, লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে ইচ্ছেটাই যে একমাত্র খোরাক সে কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য। সেই সত্যিই প্রত্যেক দুর্গাপুজোয় বনগাঁবাসীর অন্যতম আকর্ষণ। মূলত পুজোকে উপলক্ষ করেই বনগাঁর পত্রিকাগুলির বার্ষিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ফলে বছরের এই চারটে দিনের জন্য অধীর অপেক্ষার পাশাপাশি শারদীয়া পত্রিকাগুলি কবে হাতে আসবে, তা নিয়েও মানুষের মধ্যে আগ্রহ থাকে।

Advertisement

সীমান্ত মৈত্র

বনগাঁ শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৪২
Share:

পুজো উপলক্ষে প্রকাশিত এক গুচ্ছ পত্রিকা। —নিজস্ব চিত্র।

যতই হাঁড়ির হাল হোক, লিটল ম্যাগাজিন বা ছোট সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশে ইচ্ছেটাই যে একমাত্র খোরাক সে কথা প্রতিষ্ঠিত সত্য। সেই সত্যিই প্রত্যেক দুর্গাপুজোয় বনগাঁবাসীর অন্যতম আকর্ষণ। মূলত পুজোকে উপলক্ষ করেই বনগাঁর পত্রিকাগুলির বার্ষিক সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ফলে বছরের এই চারটে দিনের জন্য অধীর অপেক্ষার পাশাপাশি শারদীয়া পত্রিকাগুলি কবে হাতে আসবে, তা নিয়েও মানুষের মধ্যে আগ্রহ থাকে।

Advertisement

পত্রিকার প্রকাশকদের দাবি, রাজ্যে একমাত্র বনগাঁই পুজোকে কেন্দ্র করে এমন বিপুল ভাবে পত্রিকা প্রকাশে মেতে ওঠে। বনগাঁ শহর এবং মহকুমার প্রত্যন্ত এলাকাগুলি থেকেও এ বার প্রকাশিত হয়েছে লিটল ম্যাগাজিন। শুধু লিটল ম্যাগাজিন নয়, স্মরণিকাতেও বিজ্ঞাপনের পাশাপাশি ভাল মতো জায়গা করে নিয়েছে নানা স্বাদের সাহিত্যকীর্তি। বোঝাই যায়, অনেক যত্ন নিয়ে তৈরি স্যুভেনিয়রগুলির প্রতিটি পাতা। এ বারের পত্রপত্রিকাগুলির প্রচ্ছদও চোখে পড়ার মতো। অতীতে ভাল মানের পত্রিকা প্রকাশিত হলেও প্রচ্ছদের দিকে তেমন নজর দেওয়া হত না। কয়েক বছর হল প্রচ্ছদের বিষয়েও উদ্যোক্তারা যথেষ্ট যত্নবান হয়েছেন। শিল্পীরা এঁকেছেন বহু প্রচ্ছদ।

এ বার কচিকাঁচাদের হাত ধরেও কয়েকটি নতুন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ পেয়েছে। কবি মলয় গোস্বামীর কথায়, “শারদ উৎসবকে কেন্দ্র করে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করা বনগাঁর ঐতিহ্য। এ থেকে আমরা কখনও বিরাম পেতে চাই না।” সাংস্কৃতিক কর্মী সুশোভন দত্ত মন্তব্য করেন, “বনগাঁ শহরের মানুষ বর্তমান সময়ে যে বিষয়গুলি নিয়ে গর্ব অনুভব করেন, তার মধ্যে শারদ উৎসব উপলক্ষে সাহিত্য পত্রিকার প্রকাশ অন্যতম।” আজও পুজোর দিনগুলিতে যশোহর রোড ও বনগাঁ-চাকদহ সড়কের পাশে পত্রিকাগুলির স্টল বসে। সেখানে অতীত দিনের মতো ভিড় না থাকলেও ঐতিহ্য স্বমহিমায় টিঁকে রয়েছে।

Advertisement

এ বার ৪৬ তম বছরে পড়ল ‘শিস’ পত্রিকা। রাজনীতি ও অর্থনীতির উপর দশটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে তারা। এ ছাড়াও রয়েছে গল্প-কবিতা। চলতি বছরের ২২ এপ্রিল মাত্র ২৭ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন বনগাঁর তরুণ কবি অর্ণব দত্ত। ‘বনলতা’ পত্রিকা এ বারে তাঁকে স্মরণ করেছে। অর্ণবকে নিয়ে প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। রয়েছে অর্ণবের কিছু অপ্রকাশিত কবিতা“যে গলি ধরে আমি হাঁটতে চেয়েছি এক দিন/ সেই গলি কাউকে কোথাও পৌঁছে দেয়নি কখনও।”

‘আমাদের লোকালয়’ পত্রিকার শারদ সংখ্যার বিষয় ‘লোকালয়ের হাট’। বাগদা, বয়রা, ঠাকুরনগর, দত্তফুলিয়া, ঝাউডাঙা-সহ বহু হাটের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। ‘দিল্লি এক্সপ্রেস’ পত্রিকা তাদের শারদ সংখ্যা করেছে কথা সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘অনালোকিত বিভূতিভূষণ’। বেশ কিছু প্রবন্ধ জায়গা করে নিয়েছে তাতে। ‘কবিতা আশ্রম’ সদ্য প্রয়াত কবি জয়দেব বসুকে নিয়ে এ বারের সংখ্যা করেছে। তাঁর কবিতা ও তাঁকে নিয়ে কয়েকটি গদ্য ছাপা হয়েছে। গোপালনগর এলাকা থেকে প্রকাশিত ‘বাল্মীকি’ পত্রিকার শারদ সংখ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদারের কবিতা প্রকাশিত হয়েছে।

‘দৈনন্দিন’ পত্রিকা এ বার প্রকাশ করেছে ওই পত্রিকায় প্রকাশিত ৫৪ বছরের কবিতার সংকলন। ‘সুচেতনা’ এ বার তাদের ২৫ বছরে, উন্নতমানের সাহিত্য পরিবেশন করেছে। এ বারের সংখ্যায় অতীতকে ফিরে দেখা হয়েছে। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী-সহ বহু বিখ্যাত কবি সাহিত্যিকদের লেখা সেখানে জায়গা পেয়েছে। ‘অন্বেষা’ তাদের ২৩ তম বর্ষে ২০০ পাতার পত্রিকা প্রকাশ করেছে। স্মরণ করা হয়েছে মান্না দে, সুচিত্রা সেন, ফিরোজা বেগম, খালেদ চৌধুরীদের।

নতুন প্রকাশিত পত্রিকার মধ্যে ‘চৌকাঠ’, ‘ধুলোপথ’, ‘তৃষাণু’ পাঠকদের নজর কেড়েছে। ‘রোপণ’, ‘তারুণ্য’-এর মতো পত্রিকাও উল্লেখযোগ্য জায়গা করে নিয়েছে। এ ছাড়াও ‘পার্থিব’, ‘আমি জেগে আছি’, ‘কাশফুল’, ‘নয়দরজা’, ‘প্রতিবিম্ব’, ‘স্বাধিকার’, ‘এখন চলতে চলতে’, ‘প্রিয় মেঘদূত’, ‘বিবেকের আলোকে’, ‘দ্বৈপায়ন’, ‘তৃতীয় মেরু’-ও যথেষ্ট সম্ভাবনার ছাপ রেখেছে।

বনগাঁ শহরের অন্যতম বড় পুজো উদ্যোক্তারা এ বারেও রুচিসম্মত স্যুভেনিয়র প্রকাশ করেছেন। বিজ্ঞাপন প্রকাশের মূল উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেও সাহিত্যের জন্য তাঁরা যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছেন। শান্তি সঙ্ঘ ক্লাব এ বার তাদের স্যুভেনিয়র ‘দুর্গা’ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক ছাড়াও অপেক্ষাকৃত স্বল্প পরিচিতদের সৃষ্টিকেও জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। প্রচ্ছদটিও মনোগ্রাহী। পত্রিকার সম্পাদক চন্দন ঘোষ বলেন, “বিজ্ঞাপন মুখ্য নয়। স্যুভেনিয়রটিকে সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে প্রকাশ করাই আমাদের উদ্দেশ্য।” মতিগঞ্জ ঐক্য সম্মিলনীর ‘ঐকান্তিক’, ১২-র পল্লি স্পোর্টিং ক্লাবের ‘বোধন’, এগিয়ে চলো সঙ্ঘের ‘মধুকর’, মুস্তাফিপাড়া যুবগোষ্ঠীর ‘সংহতি’, বিদ্যায়তন ক্লাবের ‘ঝিনুক’, পাল্লা নবতরুণ সঙ্ঘের ‘নবজাগরণ’-এর কাজও এ বার প্রশংসা কুড়িয়েছে।

আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকবেই। কিন্তু এই পরম্পরা বজায় রাখতে বনগাঁর উৎসাহে যে কোনও দিন ভাটা পড়বে না এ বারের পুজো তা আরও এক বার দেখিয়ে দিল। অন্য দিকে, ক্লাব কর্তৃপক্ষের উদ্যোগ এবং সৃজনশীলতা স্থানীয় সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে বলে মনে করেন এখানকার কবি-সাহিত্যিকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন