ক্ষয়রোগে ভুগছে হুগলির আড়াইশো বছরের মন্দিরের দেবোত্তর সম্পত্তি

প্রায় ২৩৮ বছরের প্রাচীন গোপালজী মন্দির। পালা-পার্বণে দেওয়ালঘেরা চত্বরের ভিতরে এখনও ভিড় হয়। ক্ষয়রোগে ভুগছে হুগলির আটপুরের এই দেবোত্তর সম্পত্তির অনুপম মন্দির।

Advertisement

অশোক সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৯ নভেম্বর ২০১৫ ১৫:৫৫
Share:

এক-আধ বিঘা নয়, হাজার হাজার বিঘা জমি, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি ওঁরা লিখে দিয়েছিলেন কুলদেবতার নামে। ওঁরা মানে, বাংলার সাবেক রাজা-জমিদারেরা। দেবস্থানগুলো আজ সেবায়েতদের কাছে মাথাব্যথার কারণ, নিছকই ঐতিহ্যের বাহক।

Advertisement

প্রায় ২৩৮ বছরের প্রাচীন গোপালজী মন্দির। পালা-পার্বণে দেওয়ালঘেরা চত্বরের ভিতরে এখনও ভিড় হয়। বাইরে কিন্তু ঝকঝকে ভাবটা একেবারে নেই। হলদিয়ায় মহিষাদল রাজবাড়ি চত্বরে ১৭৭৮-এ রানি জানকী দেবী তৈরি করান মন্দির। শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশে নিবেদিত। রাণিমার তৈরি প্রায় ৯০ ফুট উঁচু রামজির মন্দির। ওখানে ছিল রাম, সীতা ও হনুমানের দু’টি করে ও লক্ষ্মণের একটি মূর্তি। এই সব বিগ্রহের উদ্দেশেই নিবেদিত হয়েছিল মহিষাদলের বিস্তীর্ণ এলাকা। ‘রাজা’দের দাপট আর বৈভব কমতে থাকার সঙ্গে সঙ্গে জৌলুস কমতে থাকে দেবস্থানেরও।

১৯৬৭-তে মন্দির থেকে চুরি যায় অষ্টধাতুর বিগ্রহ। প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন একটি। ঠিক পিছনে দেওয়ান হাউস, দুবে প্যালেস। এ ছাড়াও আছে ১৯১৭-তে তৈরি নাটশাল, শিবমন্দির, পঞ্চানন্দ মন্দির। ১৯৯৯-তে রামকৃষ্ণ পরমহংসের জন্মশতবর্ষে উদ্বোধন হয় মুক্তিধাম মন্দিরের। সুন্দর স্থাপত্যের এই ধর্মস্থানে আছে কালী, রাধাকৃষ্ণ ও হনুমানের মূর্তি। ১৮৩০-এ সতীপ্রসাদ গর্গ তৈরি করান সুন্দর মন্দির। এখন সবের জৌলুস আরও কমেছে। তবে, পুজো হয় নিয়মিত। বিয়ের পর নবদম্পতিরা মন্দিরে আসেন মায়ের আশীর্বাদ নিতে। ঘটা করে হয় রথযাত্রা। পরিবারের বর্তমান কর্তা শঙ্করপ্রসাদ গর্গ জানান, ‘‘এত বড় সম্পত্তি। বিস্তর খরচ। বাধ্য হয়ে সিনেমার সুটিংয়ে ভাড়া দিচ্ছি।’’

Advertisement

হাওড়া থেকে ট্রেনে ১৬-তম স্টেশন, তারকেশ্বর থেকে তিনটি স্টেশন আগে হরিপাল। বর্ধমানের মহারাজার দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র মিত্র প্রায় ২৩০ বছর আগে আটপুরের জঙ্গল কাটিয়ে এই এলাকায় জমিদারির পত্তন করেন। তৈরি করান একগুচ্ছ মন্দির। দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত হয় অনেকটা এলাকা। স্টেশন থেকে ট্রেকারে মিনিট পঁয়তাল্লিশের পথ। ঝিলের পারে প্রাচীন পাকুর বৃক্ষ। বাঁধানো বেদি। পাশে বড় ফলকে লেখা, বৃক্ষের বয়স পাঁচশরও বেশি। বাঁ পাশে খুব বড় চন্ডীমন্ডপ। ঠিক পিছনে ১০০ ফুট উঁচু রাধাগোবিন্দ মন্দির। অদূরে রাসমঞ্চ ও আরও পাঁচটি মন্দির।

ক্ষয়রোগে ভুগছে হুগলির আটপুরের এই দেবোত্তর সম্পত্তির অনুপম মন্দির। টেরোকোটার টালিতে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল প্রাচীন সমাজ জীবনের নানা আলেখ্য। যে বিগ্রহদের দান করেন বিশাল এলাকা, কালের ছোবলে সেই দেবস্থান নষ্ট হতে বসেছে। শিবমন্দিরগুলোয় অবশ্য পুজো হয়। নিয়মিত পুজো হয় রাধাগোবিন্দ মন্দিরে। চার দশক ধরে প্রধান পূজারির দায়িত্ব সামলাচ্ছেন শম্ভুচরণ ভট্টাচার্য। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মিত্রর বর্তমান উত্তরাধিকাররা তৈরি করেছেন ‘মিত্রসঙ্ঘ’। এর সম্পাদক অপর্ণা মিত্র বলেন, ‘‘এবার আমাদের দুর্গাপুজোর বয়স হল ৩২৫। কালীপুজোটিও খুব প্রাচীন। এ ছাড়া রাস, ঝুলন, জন্মাষ্টমী এ সব নিয়মিত হচ্ছে।’’

পশ্চিম মেদিনীপুরের চিল্কিগড়ের রাজবাড়ির অধীনে ছিল এক হাজার একরের বেশি জমি। এর অনেকটা দেবোত্তর করে দেওয়া হয়েছিল। চিল্কিগড়ে প্রাচীন কণকদূর্গা মন্দিরগাত্রে ওড়িশি ও অনার্য ছাপ। আগাছায় ঘেরা ত্রিশ ফুট উঁচু, পরিত্যক্ত মন্দিরে বড় ফাটল। এর নির্মাতা রাজা বিশ্বরূপ ত্রিপাঠি ছিলেন বিষ্ণুভক্ত। তাই মন্দিরের শিখরে বিষ্ণুচক্র। পাশে ১৯৩৭-এ তৈরি নয়া মন্দির। ১৯৯৪-তে সংস্কার হয় এটি। সেবায়েত বীর্যেশ ধবলদেব বলেন, ‘‘দক্ষিণ জামবনির দিকে প্রায় সাড়ে চারশ একর জমিতে চাষ হত। সে সব জমি এখন প্রায় বেহাত।’’ তিনি বলেন, মূল রাজবাড়ির কালাচাঁদ, জগন্নাথ, রাধাকৃষ্ণ এবং কিছু শিলা— এ সব পুজোর আয়োজন করতে হয় নিয়মিত। খুবই সমস্যায় পড়তে হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন