বিস্ফোরণ-কাণ্ডে আহত আব্দুল হাকিমকে আনা হল এসএসকেএম হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার সুমন বল্লভের তোলা ছবি।
খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডে কওসর ছাড়াও আরও তিন বাংলাদেশি জামাত নেতাকে খুঁজছে সিআইডি। এরা হল হাতকাটা নাসিরুল্লা, সাকিব এবং সাজিদ। সিআইডি অফিসারদের দাবি, এই চার জামাত নেতা পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড়ের মতো বিভিন্ন ডেরা থেকে বিস্ফোরক ও বোমা চালান করত বাংলাদেশে। ঢাকায় শেখ হাসিনা সরকারের হাত এড়িয়ে বিস্ফোরক তৈরির কাজ হাসিল করতেই এ রাজ্যে বছরের পর বছর বসে থেকে জঙ্গি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল তারা। আবার ওই বিস্ফোরকের একটা অংশ ভারতে নাশকতার কাজে ব্যবহার করাও জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল বলে তদন্তকারীদের সন্দেহ।
বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকে বছর সাতেক আগে এ দেশে ঢোকা শাকিল আহমেদ অষ্টমীর দিন খাগড়াগড়ের ডেরায় বিস্ফোরণে মারা যায়। সিআইডি-র হাতে ধরা পড়ে আহত আব্দুল হাকিম, তার স্ত্রী আলিমা বিবি এবং শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া ওরফে গুলশানা বিবি। তাদের জেরা করেই সিআইডি জেনেছে, খাগড়াগড়ে শাকিল যে বোমা তৈরি করত, কওসর তার কয়েক জন সহযোগীর মাধ্যমে তা পৌঁছে দিত বেলডাঙার বড়ুয়া মোড়ের এক ডেরায় সাকিবের জিম্মায়। কওসরকে এই কাজে সাহায্য করত হাতকাটা নাসিরুল্লা। সাকিব সেই বোমা পৌঁছে দিত লালগোলায় বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা অন্য একটি ডেরায়। যেখান থেকে জামাত নেতা সাজিদ তা চালান করত সীমান্তপারের রাজশাহি কিংবা সাতক্ষীরায়। এ ভাবেই এ-পারে তৈরি হওয়া অস্ত্রে মজবুত হচ্ছিল ‘জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ’ বা জেএমবি-র ভাণ্ডার।
এই চার জনের পাশাপাশি মহম্মদ ইউসুফ নামে আর এক বাংলাদেশি জামাত নেতার নামও সিআইডি তদন্তে উঠে এসেছে। সিআইডি সূত্র জানাচ্ছে, এ রাজ্যে জামাতের শাখা সংগঠন বিস্তার, জঙ্গিদের নিয়োগ করে অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং ধর্মশিক্ষা দেওয়ার কাজ ছিল ইউসুফের। এখানেও তার সহকারী ছিল হাতকাটা নাসিরুল্লা। সিআইডি-র দাবি, রাজিয়া এবং আলিমা, দু’জনেই ইউসুফ ও নাসিরুল্লার কাছ থেকে অস্ত্র প্রশিক্ষণ পেয়েছে বলে জানিয়েছে।
কেন এ-পার বাংলায় অস্ত্র তৈরি করে ও-পারে পাঠাচ্ছিল জেএমবি? বর্ধমানেই বা তারা ডেরা বাঁধল কেন?
সিআইডি-র দাবি, জেরার মুখে শাকিলের স্ত্রী রাজিয়া জানিয়েছে, জেএমবি-র লক্ষ্য, জেহাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে জামাতের সরকার প্রতিষ্ঠা করা। আর সেই জেহাদের জন্য চাই বিস্ফোরক, বোমা। বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের তৎপরতায় নিষিদ্ধ জেএমবি-র বোমা তৈরির কারবার গত দু’তিন বছর ধরে কার্যত বন্ধ। তাই ওই জঙ্গি সংগঠনের বেশ কিছু চাঁই এ রাজ্যে ঢুকে পড়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের কাজ চালাচ্ছিল। খাগড়াগড় ছিল সে রকমই একটি বোমা তৈরির কেন্দ্র। রাজিয়া বলেছে, “আমার স্বামী বলত, সুদিন আসবে। আবার দেশে ফিরব। জেহাদ করতে হবে। সে জন্যই এখন এই কাজ করছি।” সিআইডি অফিসারেরা জানতে চান, বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। তা হলে ওখানে কার বিরুদ্ধে জেহাদ হবে? আলিমারা জানায়, “জামাতের সরকার আনতে জেহাদই করতে হবে।”
গোয়েন্দারা জেনেছেন, বাংলাদেশ থেকে টাকাপয়সা এলেও বোমার রসদ জোগাড় করতে হতো ভারত থেকেই। বর্ধমানে ঘাঁটি তৈরির অন্যতম কারণ সেটাই। কারণ, বর্ধমানের কাছেই ঝাড়খণ্ডের খনি এলাকা ও কলকাতা। শাকিল, কওসরের নিয়মিত রানিগঞ্জ-আসানসোলে যাতায়াত ছিল। হাকিমের বাড়ি বীরভূমের দেউচা পাথরখাদান এলাকায়। খাদানে বিস্ফোরণের জন্য সর্বত্রই জিলেটিন স্টিকের বহুল ব্যবহার রয়েছে। ফলে বিস্ফোরক জোগাড় করা তেমন কঠিন ছিল না। শাকিল-হাকিমরা যে ধরনের সকেট বোমা বানাত, তার রসদ তারা খনি-খাদান এলাকা থেকেই সংগ্রহ করে থাকতে পারে বলে সন্দেহ সিআইডি-র।
মুর্শিদাবাদের বেলডাঙার বড়ুয়া মোড়ে শাকিলদের অন্য আস্তানাটিও বেশ পাকাপোক্ত ভাবে গড়ে উঠেছিল। মধ্যবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গে জাল ছড়াতে জুন মাসে তারা বর্ধমানে বাড়ি ভাড়া নেয়। মঙ্গলকোটের শিমুলিয়ায় জেএমবি-র অস্ত্র প্রশিক্ষণ এবং সদস্য সংগ্রহের একটি ঘাঁটি ছিল। রাজিয়া ও আলিমা সিআইডি-কে জানিয়েছে, গত চার বছরে শিমুলিয়া থেকে অন্তত ১৫ জন যুবক-যুবতী অস্ত্র প্রশিক্ষণ ও ধর্মশিক্ষা শেষ করে জেএমবি সদস্য হয়েছে। রাজ্যের নানা জায়গায় তারা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজও করছে। যার মধ্যে পাঁচ-ছ’জন খাগড়াগড়েও ছিল বলে তারা সিআইডি-কে জানিয়েছে।
সিআইডি জেনেছে, গত জুন মাসে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার হাসান চৌধুরীর বাড়িতে ওঠে শাকিল ও হাকিমের পরিবার। সেই ঘাঁটিতেই ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) তৈরি করে তা দফায় দফায় মঙ্গলকোট, পূর্বস্থলী, বেলডাঙা, লালগোলা হয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হতে থাকে। সিআইডি-র দাবি, জেরায় জানা গিয়েছে, কিছু বোমা পাঠানো হয়েছিল ৩০ সেপ্টেম্বর, ষষ্ঠীর দিন। এর পর সপ্তমীতেও খাগড়াগড়ের ডেরায় যায় কওসর। ওই দিন সে বেশ কিছু বোমা তৈরির বরাত দিয়ে আসে শাকিলদের। ঠিক পরের দিন, অষ্টমীতেই কওসরের ওই বোমাগুলি নিতে আসার কথা ছিল। ঠিক ছিল, কওসর তার শ্বশুরবাড়ি কীর্ণাহার হয়ে রঘুনাথগঞ্জ, বেলডাঙা হয়ে লালগোলা পৌঁছে দেবে ওই বিস্ফোরক। সেইমতো দু’টি পথেই বোমা নিয়ে যাওয়ার মহড়া দিয়ে রেখেছিল তারা। খাগড়াগড়ে সকেট বোমার পাশাপাশি চিনা খেলনায় বিস্ফোরক ঠেসেও বানানো হচ্ছিল আইইডি। কিন্তু এক রাতের মধ্যে তাড়াহুড়ো করে প্রচুর সংখ্যক বোমা বানাতে গিয়েই ঘটে বিস্ফোরণ। মারা পড়ে শাকিল এবং স্বপন মণ্ডল ওরফে সুবহান। তার পর থেকেই খোঁজ নেই হাতকাটা নাসিরুল্লা, ইউসুফ, সাকিব, সাজিদ ও কওসরের।