৪০ ডাক্তারের রক্তে পুনর্জন্ম

ওঁরা সে দিন রে-রে করে তেড়েফুঁড়ে ইমার্জেন্সিতে ঢুকেছিলেন। ওই মানুষগুলিই এখন মরমে মরে যাচ্ছেন। ভাবছেন, ডাক্তারবাবুদের ঋণ কী ভাবে মেটানো যায়। এ-ও বলছেন, যা-ই করি না কেন, জীবনদানের দেনা শুধব কী করে?

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩২
Share:

মেয়ে কোলে স্বামীর পাশে আয়েশা।—নিজস্ব চিত্র।

ওঁরা সে দিন রে-রে করে তেড়েফুঁড়ে ইমার্জেন্সিতে ঢুকেছিলেন। ওই মানুষগুলিই এখন মরমে মরে যাচ্ছেন। ভাবছেন, ডাক্তারবাবুদের ঋণ কী ভাবে মেটানো যায়। এ-ও বলছেন, যা-ই করি না কেন, জীবনদানের দেনা শুধব কী করে?

Advertisement

সরকারি হাসপাতালে কথায় কথায় ডাক্তারদের মারধর করা প্রায় রেওয়াজে দাঁড়িয়েছে। গত ১৩ জুন তেমনই কিছু ঘটতে চলেছিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। কিন্তু সিনিয়র-জুনিয়র ডাক্তারেরা মিলে এক সাপে-কাটা তরুণী ও তাঁর গর্ভস্থ শিশুকে বাঁচাতে যা করলেন, তা রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের মলিন ছবিটাকে উজ্জ্বল করে দিয়েছে। তাঁদের তিন সপ্তাহের চেষ্টায় বধূ প্রাণেই বাঁচেননি, দিন গুনছেন, কবে বাড়ি ফিরে একরত্তি মেয়েকে কোলে নেবেন।

হাওড়ার চেঙ্গাইলের মোল্লাপাড়ার বাসিন্দা তেইশ বছরের আয়েশা বেগমকে বিষধর সাপে কামড়েছিল। স্থানীয় হাসপাতাল ঘুরে সাড়ে সাত মাসের ওই অন্তঃসত্ত্বাকে নিয়ে বাড়ির লোক যখন কলকাতায় আসেন, ততক্ষণে চব্বিশ ঘণ্টা পার। আয়েষার অবস্থা রীতিমতো খারাপ। মেডিক্যালের ইমার্জেন্সিতে উত্তেজিত আত্মীয়দের হাবভাব-কথাবার্তায় ডাক্তারেরা প্রমাদ গুনেছিলেন। ফাঁড়ির পুলিশও সতর্ক হয়ে ওঠে। তবে ডাক্তারেরাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পরিস্থিতি বেবাক বদলে দিয়েছেন।

Advertisement

কী ভাবে?

প্রাথমিক পরীক্ষায় দেখা যায়, আয়েশার দুটো কিডনিই বিকল। প্রস্রাব বন্ধ। চাকা চাকা দাগে ভর্তি শরীর ফুলেও গিয়েছে। সঙ্গে প্রবল শ্বাসকষ্ট। অথচ গর্ভস্থ সন্তানের স্বার্থে খুব কড়া ডোজের ওষুধ-ইঞ্জেকশন দেওয়া অসম্ভব। ‘‘এমনিতেই সাপের বিষে জরায়ুর সন্তান নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। তার উপরে কড়া ওষুধ পড়লে সন্তানের মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত।’’— বলছেন এক চিকিৎসক।

এমতাবস্থায় ঝুঁকি নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, রোগিণীকে গাইনিতে পাঠিয়ে স্বাভাবিক প্রসব করানো হবে। বিশেষ ওষুধে প্রসব বেদনা জাগিয়ে তা-ই করা হল। সময়ের আগে জন্মানো (প্রিম্যাচিওর) কম ওজনের শিশুটিকে এসএনসিইউয়ে পাঠিয়ে আয়েশার চিকিৎসায় নেমে পড়েন ডাক্তারেরা।

আর সেখানেই অপেক্ষা করছিল মস্ত চ্যালেঞ্জ। বিষের তেজে আয়েশার রক্ত দ্রুত নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। প্রচুর ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা দরকার। এ দিকে ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্ত নেই! রণে ভঙ্গ না-দিয়ে চল্লিশ জন জুনিয়র ডাক্তার এগিয়ে আসেন। তাঁদের প্লাজমা নিয়ে লড়াই চলে। এক ডাক্তারের কথায়, ‘‘কখনও মনে হচ্ছিল, একটু ভাল। পরের মুহূর্তে হয়তো এমন বাড়াবাড়ি যে, সোজা ভেন্টিলেশনে। সামান্য স্থিতিশীল করে ফের প্লাজমা।’’

এ ভাবে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে আয়েশা এখন বিপন্মুক্ত। বাচ্চাও ভাল আছে, তাকে ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে নানা মহলের আলোচনায় উঠে আসছে আরজিকরের চিকিৎসক অমিয় রায়চৌধুরীর নাম। তিনিই প্রথম সর্পাঘাতে মৃতপ্রায় এক জনকে রক্ত বদল করে সুস্থ করেছিলেন। স্বীকৃতিহিসেবে তাঁকে নিউ ইয়র্ক সায়েন্স অ্যাকাডেমির সদস্য করা হয়।

অমিয়বাবুর পড়াশোনা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে। সেই হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি তাঁর ঐতিহ্য বহন করেছে। মেডিক্যালের মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক-চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার ছিলেন আয়েশার দায়িত্বে। ‘টিমওয়ার্ক’কে কৃতিত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তারবাবুরা একযোগে না-লড়লে আয়েশা বা তাঁর সন্তানকে বাঁচানো যেত না।’’ সমবেত প্রয়াসকে কুর্নিশ করে মেডিক্যালের স্ত্রীরোগ চিকিৎসক তপন নস্করের প্রতিক্রিয়া, ‘‘গর্ভে সন্তান থাকলে অ্যান্টিভেনম দেওয়া যায় না। এ দিকে বিষ ছড়াতে থাকায় বাচ্চার ক্ষতির আশঙ্কা ষোলো আনা। তাই বাড়ির লোককে বলেছিলাম, বাচ্চাকে বাঁচানোর আশা প্রায় নেই।’’

সব দিক রক্ষা পাওয়ায় ওঁদের তৃপ্তির শেষ নেই। আয়েশার বাড়ির লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না। আত্মীয়েরা মানছেন, প্রথম রাতে তাঁদের মনেও নানা সন্দেহ-অবিশ্বাস ছিল। ডাক্তারবাবুরা পুরো ধারণা পাল্টে দিয়েছেন। ‘‘ওঁরা তো আমাদের রক্তের ঋণে বেঁধেছেন!’’— মন্তব্য পরিজনদের। আয়েশার স্বামী সিরাজুল ইসলামের কথায়, ‘‘মেয়ে বাড়ি চলে এসেছে। স্ত্রী সুস্থ। সত্যি, এতটা ভাবতে পারিনি।’’ আয়েশা নিজে? তরুণী বলেন, ‘‘এখনও যে বেঁচে আছি, বাচ্চার মুখ দেখেছি, সে তো ডাক্তারবাবুদের দয়াতেই!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন