যুদ্ধ জিতেও নয়া লড়াই অ্যাসিড আক্রান্তর

ছ’বছর ধরে এক লড়াইয়ে অবশেষে জয় এসেছে। এ বার তাঁর নতুন লড়াই শুরু। অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া মুখ সারাতে ছ’বছর ধরে চলছিল প্লাস্টিক সার্জারি, স্কিন গ্রাফটিং। অস্ত্রোপচার হয়েছে ছ’বার। শুনতে হয়েছে হুমকি।

Advertisement

অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:১৪
Share:

মায়ের সঙ্গে সেই অ্যাসিড আক্রান্ত।—নিজস্ব চিত্র

ছ’বছর ধরে এক লড়াইয়ে অবশেষে জয় এসেছে। এ বার তাঁর নতুন লড়াই শুরু।

Advertisement

অ্যাসিডে পুড়ে যাওয়া মুখ সারাতে ছ’বছর ধরে চলছিল প্লাস্টিক সার্জারি, স্কিন গ্রাফটিং। অস্ত্রোপচার হয়েছে ছ’বার। শুনতে হয়েছে হুমকি। ধর্ষণেরও শিকার হয়েছেন। তার মধ্যেই বারবার দৌড়েছেন উকিলের কাছে, আদালতে। এ সব করতে সর্বস্বান্ত হয়েছেন। তবু হাল ছাড়েননি।

সেই লড়াইয়ে বুধবার জিতেছেন উত্তর ২৪ পরগনার অ্যাসিড-আক্রান্ত বছর ছাব্বিশের যুবতী। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে তাঁর বান্ধবীর বাবা, আমডাঙার জামালুদ্দিন মল্লিক ওরফে জামালের। যে জামালের কুপ্রস্তাব প্রত্যাখান করায় যুবতীর উপরে ২০১০ সালে অ্যাসিড হামলা হয়। পরে তাঁকে অপহরণ করে একাধিকবার ধর্ষণ। সেই যুবতী এ বার শুরু করতে চলেছেন জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার লড়াই। বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘‘এত দিন লড়াইয়ে মা-বাবা, বোন পাশে ছিল। এ বার চাকরি নিয়ে পরিবারের স্বাচ্ছন্দ্য ফিরিয়ে দিতে চাই।’’

Advertisement

এখনও বাইরের লোকের সামনে ওড়নায় মুখ ঢেকে থাকেন যুবতী। ছ’বছর আগে যখন আক্রান্ত হন, তিনি তখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছবি আঁকা শেখাতে যাওয়ার সময় তাঁর উপর অ্যাসিড ছোড়ে জামাল। মামলা প্রত্যাহারের জন্য আসতে থাকে চাপ। রাজি না হওয়ায় তাঁর মাকেও ধর্ষণ করা হয়। জামাল তখন প্রভাবশালী সিপিএম নেতা। তাঁর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলছিলেন যুবতী। তাঁর কথায়, ‘‘এক দিকে শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা, অন্য দিকে মামলা তুলে নেওয়ার চাপ। সব মিলিয়ে কখনও মনে হচ্ছিল মরে যাই। তার পর মনে হয়, মরে গেলে তো লোকটার শাস্তি হবে না। মা-বাবা কত কষ্ট করে চিকিৎসা, মামলার টাকা জোগাড় করছে।’’

মেয়ের চিকিৎসা, মামলা চালাতে গিয়ে ইতিমধ্যে পরিবারের খরচ হয়ে গিয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা। বিক্রি হয়ে গিয়েছে তাঁদের সবেধন দু’বিঘা জমি। বন্ধক রাখা হয়েছে সোনা। যুবতীর বাবা এখন দিনমজুরি করেন। মা স্কুলে মিড-ডে মিল রান্না করেন। শেষ দিকে লড়াইয়ে যুবতী পাশে পেয়ে যান আত্মীয়-পড়শিদেরও। তাঁদের কথায়, ‘‘ওঁর মনের জোর সাংঘাতিক। তাই আমরাও এগিয়ে যাই।’’ এসএসকেএম হাসপাতালে প্লাস্টিক সার্জারি হয় যুবতীর। সেখানকার ওই বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর অরিন্দম সরকারও বলেন, ‘‘অসম্ভব মনের জোর মেয়েটার। ওঁর পরিবারও সব সময় ওঁকে উৎসাহ দিয়েছে।’’

বৃহস্পতিবার রায়ের প্রতিলিপি নিতে বারাসত আদালতের সরকারি কৌঁসুলি বিপ্লব রায়ের কাছে এসেছিলেন মা-মেয়ে। বিপ্লববাবু বলেন, ‘‘মামলায় সাজার আগে অনেক বিষয় থাকে। ২২ জন সাক্ষী ছিলেন। আদালতের কাজে অসুস্থ শরীরে মেয়েটির সহযোগিতা আর ধৈর্য আর এক বিরল ঘটনা।’’

এখনও যুবতী পুরো সুস্থ নন। মাস দু’য়েক আগে নাকের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল ঠোঁট। ফের অস্ত্রোপচার করতে হয়। বন্ধ পড়াশোনা, ছবি আঁকা। তবু সে সব আমল না দিয়ে যুবতী বলেন, ‘‘দোষী সাজা পেল। এটাই চাইছিলাম। এ বার চাকরি চাই। পরিবারটাকে চালাতে হবে।’’

গলায় সেই পুরনো জেদ। যেমনটা শোনা গিয়েছিল জয়নগরের অ্যাসিড আক্রান্ত মনীষা পৈলানের বেলাতেও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন