অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়
সরু রাস্তাটা তস্য সরু হয়ে গিয়েছে দোকানের দাপটে। দু’দণ্ড থমকে গেলে পিছন থেকে অজস্র রিকশা-অটোর নির্দয় ধমক। কলকাতার পূর্ব শহরতলী, কেষ্টপুরের সেই ঢালু রাস্তাটায় খানিক গড়িয়ে গিয়েই সে দিন থমকে পড়েছিলেন তিনি— ‘‘চাঁদটা দেখেছ!’’
মাথার উপরে অজস্র তারের ঠাসবুনট জাল ফুঁড়ে অঘ্রানের একখানি ফ্যালফ্যালে হলুদ চাঁদ। ঈষৎ ময়লা ধুতি, হালকা পাঞ্জাবি, আকাশের দিকে আঙুল তুলে অঘ্রানের চাঁদ দেখাচ্ছেন— ‘‘তোমার কিছু মনে হচ্ছে, কোনও পুরনো কিছু!’’ থমথম করে সেই গলা।
শেষ বাসে বাড়ি ফিরছি, সে রাতে মনে হয়েছিল, একটা অলৌকিক জলযান বুঝি আমায় ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে সবুজ খেতের কচ্ছপ-চড়া ধানি মাঠের মাঝ বরাবর। অফুরন্ত এক বানভাসি সমুদ্রে ভেসে চলা সেই রাত, পায়ের তলায় টলমল করা জলের তরঙ্গ, ভিজে উঠেছে শরীর...পুরনো কিছু মনে পড়ছে না তোমার...মনে মনে নিজেকে বলি গ্যাৎচোরেৎশালা!
অন্তরীক্ষের যে আঁধারে হাজারো নীলকণ্ঠ উড়িয়ে, হাততালিতে অন্ধকার ভেঙে দিয়েছিলেন সোনার জেঠামশাই, যে পাখিরা ফিরব ফিরব করেও, কোনও দিন আর ফিরে আসেনি, তারা বুঝি চলে গিয়েও আকাশের নির্জনতায় রয়ে গিয়েছে আজও। কেষ্টপুরের সেই ক্ষীণ গলির বাড়ি ছেড়ে অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের শায়িত দেহটা টলমল করে ফিরে যাওয়ার সময়েও সে দিন মনে হল, কোনও এক অলৌকিক জলযান তাঁকে ঈশ্বরের বাগানে নিয়ে চললেন।
প্রথম আলাপটা অবশ্য কিঞ্চিৎ তপ্ত। ভোটের সময়, ইভিএম নয়। তখনও ব্যালট গুনে ভোট। মুহুর্মুহু গুলির মতো ফল আসছে। ফোনটা এল তখনই।
—‘ফল কী দাড়াল ভাই?’
আমার গলায় বিরক্তি ছিল বেশ, ‘‘কে বলছেন?’’
সংক্ষিপ্ত জবাব এল
— ‘অতীন।’
এ পাশ থেকেও ছোট্ট জবাব ফিরে গেল, ‘পরে করুন।’
—কেন? ফল জানতে চাইছি...বলা বারণ নাকি!
খুব ঠান্ডা গলায় বলি, ‘কাগজে এই সময়ে ঠিক কতটা নাকে-মুখে অবস্থায় থাকি, জানেন? এখন যা শুনবেন, ফলটা কাল সকালের গরম কাগজে একই থাকবে, কথা দিলাম পরিবর্তন হবে না!’
ঝগড়াটা, আরও কিছু চোখা শব্দের অনুষঙ্গে গড়িয়ে চলার মাঝে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম ফোনের ওপারের মানুষটি নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ করছেন! ক্ষমা চেয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই বললেন,
—বেশ কথা বলেন তো ভাই, নাম কী?
বাইশ বছর আগের, এক নির্বাচনী রাতে যে আলাপটা জমাট বেঁধেছিল এ ভাবে, শেষ কয়েক বছরে, তা ক্ষীণ হলেও ‘একটি জলের রেখা’ হয়ে থেকে গিয়েছিল বুঝি। দেখা হলে ধরিয়ে দিতেন, ‘‘সেই রাতের ঝগড়াটা মনে আছে তো!’’
মনে আছে অতীনদা। মনে আছে ধানি জমিতে স্বল্প জলে উঠে আসা সেই সব জলজ কচ্ছপের কথা, মনে আছে এখনও অবিরল সমুদ্রে বুনো ফুলের গন্ধ। আর মনে আছে বলেই রাতের অন্ধকারে শীতের মাঠে হয়ত অনাবিল কোনও পাপই অন্বেষণ করে বেড়াই আমি। তার পরে হেরে গিয়ে, নিজেকে বলি— গ্যাৎচোরেৎশালা!