Kalachand Darbesh

হৃদয় কপাট দেখ না খুলে, ঘরের মানুষ ঘরেই খাড়া

এর পর স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পথে নামলেন, পথের অন্বেষণে দরবেশি সাধনমার্গের অনুসারী হলেন, নিশ্চিত আয়ের পথ ছেড়ে ধরলেন মাধুকরী।

Advertisement

দেব চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৭ ১৪:৩৬
Share:

কালাচাঁদ দরবেশ।

২০০২ সালের জুলাইতে কামরূপ এক্সপ্রেসে করে উত্তরবঙ্গ যাচ্ছিলাম। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে রঙচঙে জোব্বা পরিহিত একজন দাড়িওয়ালা মানুষ ট্রেনে গান গাইতে উঠলেন। হাতে এক অদ্ভুত বাদ্যযন্ত্র, যেটা ঠিক দোতারা নয় এবং গানটাও আগে শোনা কোনও গান নয়। জিজ্ঞাসা করতে নিজের পরিচয় দিলেন ‘কালাচাঁদ দরবেশ’। আর হাতের যন্ত্রটি দেখিয়ে বললেন, ‘এটি স্বরাজ, আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব বাজাইতেন’। কালাচাঁদ কৃষ্ণের অন্যতম নাম, তার সঙ্গে উচ্চারিত এই দরবেশ শব্দটি যেন সেই আরব্য রজনীর পাতা থেকে উঠে এল। আমার আগ্রহ বেড়ে গেল।

Advertisement

তার আগে বাউল-ফকির গান শুনেছি, কিন্তু দরবেশি গান কখনও শুনিনি। সেই দিন থেকে ওঁকে অনুসরণ করা শুরু করি। জানলাম ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত উনি ছিলেন ধূপগুড়ির ঠুনকিরঝাড় হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক। এই সময় ওঁর হঠাত্ করেই মনে হয়, এই জগত্সংসার অনিত্য, সবই মিথ্যে। দীক্ষা নিলেন গুরু রাধাচরণ দরবেশের কাছে। এর পর স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পথে নামলেন, পথের অন্বেষণে দরবেশি সাধনমার্গের অনুসারী হলেন, নিশ্চিত আয়ের পথ ছেড়ে ধরলেন মাধুকরী।

ওঁর সঙ্গে পথ চলতে গিয়ে আমার দরবেশি গান নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার শুরু। জানতে পারি, সেই মুহূর্তে তিনিই এ বাংলার একমাত্র জীবিত দরবেশি সাধক ও গায়ক। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে দু’ বাংলায় বহু দরবেশ থাকলেও, এ পার বাংলায় তিনিই ছিলেন শেষ দরবেশি সাধক ও গায়ক।

Advertisement

সহজিয়া উৎসবের মঞ্চে তিনিই সে দিন মধ্যমণি।

১৯৮৯-তে তিনি পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯৯০-এ লন্ডনে অনুষ্ঠিত ‘ভারত মেলা’য় অমিতাভ বচ্চন তাঁর অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন, পণ্ডিত জাকির হোসেন তাঁর সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন, অথচ এই আন্তর্জাতিক বর্ণময় চরিত্র ২০০৭-০৮ পর্যন্ত ট্রেনে ট্রেনে গান গেয়ে মাধুকরী করতেন। জানতে পারি, ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও ব্রিটেনের লন্ডন ও স্কটল্যান্ড, ফ্রান্সের প্যারিস-তুঁলুস-পম্পেদু, আফ্রিকার মরক্কো-সহ নানা দেশে উনি অনুষ্ঠান করেছেন। ১৯৯০ সালে ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং এর পর থেকে বহু জায়গায় দরবেশি গান, জীবনযাপন ও দর্শনের উপর বক্তব্য রেখেছেন এবং কর্মশালা করিয়েছেন।

আরও পড়ুন: সাধক-শিল্পী কালাচাঁদ দরবেশ প্রয়াত

পথ চলতে চলতে এক দিন জ্ঞানী-প্রবীণ কালাচাঁদ দরবেশ আমার কালাচাঁদদা হয়ে উঠেছেন। ২০০৬ সালে কালাচাঁদদা আমাকে ওঁর ওপর কাজ করার জন্য অনুমতি দিলেন। সেই সময় থেকে নিজের উদ্যোগেই আমি আর আমার সিনেমাটোগ্রাফার বন্ধু সুধাংশু ওঁকে অনুসরণ করতে শুরু করি। এই বিরল মানুষটিকে দীর্ঘ ছ’বছর ক্যামেরাবন্দি করার ফল ‘দরবেশি গানের সন্ধানে’ (In Search Of Darbeshi Songs) নামক তথ্যচিত্র, যা ২০১৩ সালে কলকাতার রবীন্দ্রসদনে সহজিয়া উৎসবে দেখানো হয়। সেখানেই তিনি তাঁর জীবনের শেষ মঞ্চানুষ্ঠান করেন।

এর পরেও আবার এক বার আমার ডাকেই কলকাতা ছুটে আসেন সহজিয়া ফাউন্ডেশন আয়োজিত তিনকড়ি খ্যাপার স্মরণসভায়। একটাই মাত্র গান করেন। তখন থেকেই উনি খুব অসুস্থ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ব্যবস্থাপনায় কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁর বুকে তিনটে স্টেন্ট বসে। আর আসতে পারেননি কলকাতায়। গত ১৫ বছরে কালাচাঁদদার ডাকে ধূপগুড়িতে ছুটে ছুটে গেছি ওঁর কাছে। শেষ বার অসুস্থ হয়ে শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গ স্টেট জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চার মাস আগে। সবার শুভকামনা নিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন বাড়িতে। চিকিত্সার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব সময় তাঁর পাশে ছিল।

কালাচাঁদ দরবেশের সঙ্গে এই প্রতিবেদক, পিছনে রয়েছেন মনসুর ফকিরও।

ওঁর চলার পথে পেয়েছেন বহু সম্মান। ২০১৩ সালে মুখ্যমন্ত্রী ওঁকে নজরুল পুরস্কারে ভূষিত করেন। সহজিয়া ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ২০১৩-তেই পান সহজিয়া সম্মান। ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক ও পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের ‘গুরু শিষ্য পরম্পরা’ প্রকল্পের অধীনে তিনি দরবেশি গানের গুরু হিসেবে মনোনীত হন। সহজিয়া ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে ভারত সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের আর্টিস্ট পেনশন স্কিমের অধীনে শিল্পী ভাতা পেয়েছেন। লোকসংস্কৃতি-আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র ও কসমিক হারমোনি-র নিবেদনে তাঁর দরবেশি গানের দু’টি অ্যালবাম বেরিয়েছিল।

আরও পড়ুন: কাটা ডান হাতেই জুতোয় ফোঁড় দেন বৃদ্ধ ফুলেশ্বর

১৯৩৪ সালে তাঁর জন্ম। ৮৩ বছর বয়সী এই কিংবদন্তি মানুষটির পথ চলা শেষ হয় গতকাল, রবিবার, ধূপগুড়িতে নিজের বাড়িতে। শেষ দিন পর্যন্ত গাইতে চেয়েছেন তাঁর প্রিয় দরবেশি গান। ধরে রাখতে চেয়েছেন এই পরম্পরাকে। লালন করেছেন এই সাধন মার্গ। দরবেশি জীবনযাপনে থেকেছেন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

আমাদের মতো গুটিকয় মানুষকে তিনি রেখে গেলেন এই পরম্পরাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এই মহান সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব আজ আমাদের ওপর এসে পড়ল। তাঁর শিষ্য হিসেবে আজ থেকে সেই চেষ্টা নিয়ে আমার নতুন করে পথ চলা শুরু। বাউল-ফকির-দরবেশি মতে, একই শরীরের আধারে তিন বার এই মনুষ্য জন্ম। এক বার শৈশবে, এক বার এই সহজিয়া মতে দীক্ষা-শিক্ষা লাভের দিন, শেষ বার এই মাটির শরীরের মৃত্যুর পর। মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন, ধ্রুব সত্য। এই মৃত্যুর পর অন্য এক আলোর জীবন শুরু হয়। তাই এই মাটির দেহের মৃত্যুর পর সহজ সাধকেরা কাঁদে না, গান গায়, আনন্দ করে।

তুমি তোমার নতুন জীবনের নতুন ঘরে ভাল থেকে কালাচাঁদদা। আমাদের মাথার ওপর আকাশ হয়ে থেকো...

ছবি সৌজন্যে: সহজিয়া ফাউন্ডেশন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন