যন্ত্রণার মধ্যেও মুখে ছিল আহলে হাদিস-এর নাম

পায়ে ব্যান্ডেজ। হাতে-পিঠেও চোট রয়েছে যথেষ্ট। বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত ওই জঙ্গিকে মিনিট দশেক জেরা করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ‘জেহাদ’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। হাসপাতালের শয্যায় সে অস্ফূটে কবুলও করেছিল, “আমি আহ্লে হাদিসের মতে বিশ্বাসী। জেহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা কাজ করছি।”

Advertisement

রাহুল রায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১০ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:১৩
Share:

পায়ে ব্যান্ডেজ। হাতে-পিঠেও চোট রয়েছে যথেষ্ট।

Advertisement

বর্ধমানের খাগড়াগড় বিস্ফোরণে ক্ষতবিক্ষত ওই জঙ্গিকে মিনিট দশেক জেরা করে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ‘জেহাদ’-এর প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। হাসপাতালের শয্যায় সে অস্ফূটে কবুলও করেছিল, “আমি আহলে হাদিসের মতে বিশ্বাসী। জেহাদের ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা কাজ করছি।”

বীরভূমের মহম্মদবাজারের দেউচা গ্রামের ওই যুবক, আব্দুল হাকিমের মুখে আহলে হাদিসের নাম শুনেই ভ্রূ কুঁচকেছিল গোয়েন্দাদের। বছর দেড়েক ধরে এই ধর্মীয় সংগঠনের নাম নিয়েই অনর্গল চর্চা করছেন যে তাঁরা। কেন?

Advertisement

কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ) সূত্রে জানা গিয়েছে, বিহারের বুদ্ধগয়া বিস্ফোরণের পরেই হিফাজত-ই-ইসলামি এবং আহলে হাদিস, গোয়েন্দাদের রেডারে এই দু’টি ধর্মীয় সংগঠনের নাম উঠে এসেছিল। যার প্রথমটির শেকড় যদি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম হয়, দ্বিতীয়টির প্রসার তাহলে মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-মালদহ জুড়ে। শুধু সীমান্তের জেলাই নয়, বর্ধমান, বীরভূম এমনকী কলকাতার আনাচকানাচেও, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের আড়ালে জঙ্গি-যোগের সুতোটা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছিল। আব্দুলের স্বীকারোক্তির পরে তা স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে বলে মত গোয়েন্দাদের।

শুধু তাই নয়, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা জানান, গত এক বছরে ইয়াসিন ভটকল, আসাদুল্লা আখতার (পুণের জর্মন বেকারি বিস্ফোরণ থেকে মুম্বইয়ের ৭/১১ বিস্ফোরণ কাণ্ডে অভিযুক্ত), তেহমিন আসগর (পটনা বিস্ফোরণে অভিযুক্ত) এমনকী আব্দুল করিম টুন্ডাকে (ভারতে সন্ত্রাসবাদের অন্যতম ‘মাথা’) গ্রেফতারের পরেও জেরার মুখে তারা নাম করেছিল আহলে হাদিস-এর।

এনআইএ সূত্রে জানা গিয়েছে, পটনা বিস্ফোরণের পরে আহলে হাদিস-এর তথ্যানুসন্ধানে নেমে গোয়েন্দারা জানতে পারেন দেশের ১৯টি রাজ্যে এই ধর্মীয় সংগঠনের প্রসার ঘটেছে। রাজ্যে মুর্শিদাবাদ জেলায় তাদের প্রভাব সব থেকে বেশি। তবে, ‘ধর্মীয় মত পার্থক্যের’ কারণে বছর কয়েক আগে মুর্শিদাবাদে আহলে হাদিস ভেঙে একটি নতুন সংগঠনও তৈরি হয়েছে, ‘জামিয়াতে আহলে হাদিস’।

নব্য ওই সংগঠনের মুর্শিদাবাদ শাখার সম্পাদক নজরুল ইসলাম অবশ্য দাবি করেছেন, “আমাদের সঙ্গে আহলে হাদিসের কোনও সম্পর্ক নেই। আমরা ইসলামের প্রচার ছাড়া কোনও কাজ করি না।” মুর্শিদাবাদের আহলে হাদিসের অন্যতম কর্তা আবুল কালাম আজাদের দাবি, “উগ্রপন্থায় বিশ্বাস নেই আমাদের। কোরান-হাদিসের পথেই ইসলামে বিশ্বাস করে আমাদের সম্প্রদায়।” গোয়েন্দারা অবশ্য জানাচ্ছেন, জেহাদ-এর কথা মানতে না চাইলেও আহলে হাদিস-এর একটি অংশ মৌলবাদী সংগঠন, জামাতে ইসলামি কিংবা তবলিকি জামাতের মতোই ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ পত্তনে বিশ্বাসী। খাগড়াগড় বিস্ফোরণে আহত ওই জঙ্গির কথায় তা আরও এক বার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বলেই দাবি তাঁদের। এখন প্রশ্ন, ইয়াসিন ভটকল থেকে আব্দুল হাকিম সকলের মুখেই আহলে হাদিসের নাম কেন?

গোয়েন্দা সূত্রের খবর, বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনের আড়ালে জঙ্গি কার্যকলাপ চালানো সব থেকে ‘সুবিধাজনক’। মৌলবাদী প্রচারের জন্য প্রাথমিক ভাবে জঙ্গিরা এমন একটি সংগঠনকে বেছে নেয়, সাধারণের মধ্যে যাদের যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। আহলে হাদিস-এর মতো একটি পরিচিত সংগঠনের সভ্য হয়ে জঙ্গিদের একটা বড় অংশ এ ভাবেই তলে তলে নিজেদের জাল ছড়াচ্ছে বলেই অনুুমান গোয়েন্দাদের। নমাজ পড়া কিংবা অন্য কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে স্থানীয় গ্রামবাসীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে সন্তর্পণে তাঁদের মধ্যে মৌলবাদী প্রচার, জেহাদি পুস্তিকা বিতরণ এমনকী অর্থ সাহায্য করেও নিতান্ত আটপৌরে গ্রামবাসীদের ‘মগজ ধোলাইয়ের’ চেষ্টা করছে জঙ্গিরা। সেখানে তারা নিজেদের ওই ধর্মীয় সংগঠনের সদস্য বলেই পরিচয় দিচ্ছে বলেই জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা।

তাঁদের হিসেব, গত তিন বছরে, শুধু মুর্শিদাবাদ জেলায় গড়ে উঠেছে অন্তত ৩৯টি চোখ ধাঁধানো মসজিদ। মসজিদ গড়ার এত টাকা এল কোথা থেকে, কারাই বা এর উদ্যোক্তা? গোয়েন্দারা জানান, এ সবই আহলে হাদিস-এর মতো বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে থাকা ‘নব্য মৌলবাদীদের’ কাজ। গ্রামের পুরনো মসজিদ কমিটির লোকেদের কখনও প্রলোভন দেখিয়ে কখনও বা জোর করে ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ওই সব মসজিদে। ভগবানগোলা, লালগোলা, বেলডাঙার গ্রামীণ মানুষজনকেও কার্যত ‘জোর করে’ পাঠানো হচ্ছে সেখানে। নিতান্ত দরিদ্র সেই সব গ্রামবাসীদের মন পেতে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে নগদ টাকা। সঙ্গে চলেছে, ধর্মের নামে ‘মাথা মোড়ানো’র কাজ।

রাজ্যের বিভিন্ন মুসলিম প্রধান জেলায় প্রশাসক হিসেবে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে, রাজ্যের এমন এক শীর্ষ কর্তার অভিজ্ঞতা, “সীমান্ত পেরিয়ে ওই সব অজ গাঁয়ে ঠিকানা গেড়েছেন বেশ কিছু মৌলবাদী। গ্রামবাসীদের মধ্যে টাকা বিলিয়ে, ধর্মের নামে ভুল বুঝিয়েও তাঁদের ‘জেহাদি’ তৈরির চেষ্টা করছে তারা।” রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মুর্শিদাবাদের রেজিনগরের বাসিন্দা হুমায়ুন কবীরও বলছেন, “মুসলিম ধমীর্য় সংগঠন মানেই উগ্রপন্থার আশ্রয়স্থল নয়। কিন্তু সেই সব সংগঠনেও ‘অনুপ্রবেশ’ ঘটছে মৌলবাদীদের। যারা মানুষকে ভুল বুঝিয়ে জেহাদি তৈরির চেষ্টা করছে।” গোয়েন্দাদের অনুমান, আহলে হাদিস-এর ছায়ায় সে কাজই করছে জঙ্গিরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন