১। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে সাবেক বালি পুরসভার কর্মী ধৃত প্রণব অধিকারী। শনিবার। ২। প্রণববাবুর মালিপাঁচঘরার বাড়ি থেকে বস্তাবন্দি টাকা রওনা দিল ভবানী ভবনের পথে। ৩। গ্রেফতার প্রণববাবুর ছেলে তন্ময় অধিকারীও। শনিবার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
কাগজকুড়ানিরা যেমন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বস্তায় কাগজ ভরে, শনিবার সকালে ঠিক সে ভাবেই হাওড়ার মালিপাঁচঘরা থেকে কোটি কোটি টাকা ভর্তি আটটি বস্তা, দু’টি পেল্লায় সাইজের টিনের ট্রাঙ্ক আর তিনটি ট্রলি ব্যাগ নিয়ে ভবানী ভবনে ফিরলেন রাজ্যের দুর্নীতি দমন শাখার (এসিবি) অফিসারেরা। আপাতত সেই টাকা রাখা হয়েছে সিআইডি-র হেফাজতে।
শুক্রবার দুপুর থেকে শনিবার ভোর পর্যন্ত সাবেক বালি পুরসভার সাব-অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার প্রণব অধিকারীর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ওই টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে পুলিশ। তদন্তকারীরা জানান, কেবল ৫০০ বা ১০০০ নয়, ১০০ ও ৫০ টাকার নোটও মিলেছে প্রণববাবুর বাড়িতে। টাকা গুনতে মালিপাঁচঘরা থানার পুলিশের সাহায্যে ব্যাঙ্ক থেকে মেশিন আনানো হয়। টাকা ভরে ভবানী ভবনে নিয়ে আসার জন্য আনানো হয় দু’টি বিশাল টিনের ট্রাঙ্কও।
এসিবি জানিয়েছে, তল্লাশির গোড়াতেই ধরা পড়েছিল প্রণববাবু। রাতের দিকে গ্রেফতার হয় তাঁর ছেলে তন্ময়। তিনি লিলুয়ার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে বি টেক পাস করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ উপায়ে রোজগারে সাহায্য করা ও তদন্তকারীদের মারার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ দিন দু’জনকে ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হলে বিচারক দু’দিন এসিবি-র হেফাজতের নির্দেশ দেন।
শনিবার এসিবি-র তরফে জানানো হয়, প্রণববাবুর বাড়ি থেকে এ পর্যন্ত নগদ কুড়ি কোটি সাড়ে সাত লক্ষ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়াও পাওয়া গিয়েছে ৫৮ লক্ষ টাকার ডাকঘরের ফিক্সড ডিপোজিট এবং প্রায় ১৪ লক্ষ টাকার সোনা-হিরের গয়না। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, প্রণববাবুর দোতলা বাড়িতে ছ’টি ঘর। সেগুলোর দেওয়াল, মেঝে, বক্স খাট, কমোডের ফ্লাশ, বিছানার গদির তলা, আলমারিতে মিলেছে টাকার বান্ডিল।
পুলিশ জানিয়েছে, মালিপাঁচঘরা ছাড়াও বালি ও লেকটাউনে প্রণববাবুর সম্পত্তির খোঁজ মিলেছে। তাঁকে ও তন্ময়কে হেফাজতে নিয়ে লাগাতার জেরা করলে আরও টাকার সন্ধান মিলবে বলে অনুমান তদন্তকারীদের। শনিবার রাতে বালি পুরসভার সাব-অ্যাসিন্টেট ইঞ্জিনিয়ার বাসুদেব দাসের বাড়িতেও তল্লাশি শুরু করল রাজ্যের দুর্নীতি দমন শাখার অফিসারেরা।
অফিসারদের একাংশ এক রকম নিশ্চিত, প্রণববাবুর বাড়ি থেকে যে টাকা বাজেয়াপ্ত হয়েছে তা শুধু তাঁরই নয়, একাধিক নেতার টাকা। ইতিমধ্যেই বাবা-ছেলেকে জেরা করে উঠেছে বেশ কিছু নেতার নাম, যাঁরা বিগত পুরবোর্ডে দারুণ প্রভাবশালী ছিলেন। এই বিষয়টিই এখন গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে এসিবি। বালি পুরসভার যে এলাকার বাড়ি বা বহুতলের নকশা অনুমোদন করেছেন প্রণববাবু, সেখানকার কাউন্সিলরদের
ভূমিকাও দেখতে চাইছেন তদন্তকারীরা।
প্রণববাবুর বাড়ি যেখানে সেই নস্করপাড়ার লোকজন জানান, অনেক দোকান থেকে ধারে জিনিসপত্র কিনতেন প্রণববাবুর পরিবার। পুজোর চাঁদা চাইতে গেলে অনেক তর্কাতর্কির পরে পকেট থেকে ৫১ টাকা বার করে দিতেন। এখন স্থানীয় লোকজন মনে করছেন, তাঁদের চোখে ধুলো দিতেই এই ভেক ধরেছিলেন প্রণব অধিকারী।
এসিবি সূত্রের খবর, রাজ্য দুর্নীতি দমন শাখায় যে প্রোমোটার প্রণববাবুর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ করেন, তিনি বালির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অরুণাভ লাহিড়ির বিরুদ্ধেও আঙুল তুলেছেন। সেই প্রোমোটার ভানুপ্রকাশ সিংহ বলেন, ‘‘ইঞ্জিনিয়ার টাকা চাইছেন বলে চেয়ারম্যানকে অভিযোগ জানাই। তিনি ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টে প্রণববাবুর দাবি মতো টাকা দিয়ে দিতে বলেন।’’
অরুণাভবাবু অবশ্য ঘটনাটি সাজানো বলে দাবি করেছেন। তাঁর দাবি, ‘‘আমি ওই প্রোমোটারকে চিনি না। রাজনৈতিক কারণেই আমার নাম জড়ানো হচ্ছে।’’ তিনি বলেন, ‘‘যখন ক্ষমতায় ছিলাম, তখন কেউ অভিযোগ করলেন না। হাওড়া পুরসভার সঙ্গে বালি যুক্ত হওয়ার পরে সব পরিকল্পিত ভাবে করা হচ্ছে, যাতে বালিতে সিপিএম নেতাদের বিপাকে ফেলা যায়।’’
এ দিন দুর্নীতি দমন শাখার এডিজি রামফল পাওয়ারকে ফোন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই তদন্তের বিষয়ে জানতে চান। মুখ্যমন্ত্রী রামফল পাওয়ারকে নির্দেশ দেন এই ঘটনার শিকড় খুঁজে বার করতে হবে।