প্রদেশ স্তরে আন্দোলনের বিশেষ কোনও কর্মসূচি নেই। দলের মধ্যে থেকে কোনও প্রস্তাব উঠলে তা নিয়েও জটিলতা! লোকসভা ভোটের পরে এমন সব জটিলতাতেই আটকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস।
একশো দিনের কাজের নিয়ম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সওয়াল করে কেন্দ্র-বিরোধী যৌথ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি মানস ভুঁইয়া। সেই আহ্বানে তৃণমূল এবং সিপিএম সমর্থনের ইঙ্গিত দেওয়ায় রাজ্যে বিধানসভার উপনির্বাচন এবং পুরভোটের আগে নতুন রাজনৈতিক সমীকরণও খুঁজতে শুরু করেছিলেন কেউ কেউ। কিন্তু আজ তার অঙ্কুরেই বিনাশ ঘটাতে চাইলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী। তাঁর বক্তব্য, “মানসবাবু ব্যক্তিগত ভাবে কোনও আন্দোলনে নামলে পৃথক ব্যাপার! কিন্তু প্রদেশ কংগ্রেস এ ভাবে কোনও যৌথ আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নেয়নি। এ ব্যাপারে মানসবাবুর সঙ্গে আমার কোনও আলোচনাও হয়নি!” অধীরের প্রশ্ন, একশো দিনের প্রকল্প রূপায়ণে রাজ্য স্তরে শাসক দলের দুর্নীতি ও অনিয়ম নিয়ে মানসবাবু কেন আগে আন্দোলনের কথা বলছেন না!
দিল্লিতে কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে দেখা করে কলকাতা ফিরেই একশো দিনের কাজ নিয়ে আন্দোলনের কথা বলেছিলেন মানসবাবু। বলেছিলেন, সংসদের অধিবেশন মিটে গেলে আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে প্রদেশ সভাপতির সঙ্গে আলোচনা করেই যা ঠিক করার, করা হবে। কংগ্রেসের মধ্যেই একাংশ প্রশ্ন তুলছে, তা হলে কি তলে তলে তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন মানসবাবু? সম্প্রতি কংগ্রেসের তিন বিধায়ক তৃণমূলে যোগ দেওয়ার পরে দলের যে কেউই এমনিতে এখন সন্দেহের তালিকায়! প্রদেশ সভাপতির সঙ্গে আলোচনা না-করেই মানসবাবু ‘ব্যক্তিগত প্রস্তাব’ প্রকাশ্যে আনতে গেলেন কেন, সেই প্রশ্ন তুলেই তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর নাম জড়াচ্ছেন দলের কেউ কেউ।
দিল্লিতে সম্প্রতি তৃণমূল নেতা মুকুল রায়ের সঙ্গে মুর্শিদাবাদের প্রাক্তন কংগ্রেস সাংসদ মান্নান হোসেনের বৈঠকের খবর ঘিরেও জল্পনা বাড়ছে দলে। সূত্রের খবর, দিল্লিতে মুকুলবাবুর বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন মান্নান। যদিও দুই নেতাই তৃণমূলের সঙ্গে এমন আঁতাঁতের তত্ত্ব সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন। মানসবাবুর বক্তব্য, “তৃণমূলের সঙ্গে যোগাযোগ নিয়ে যে যা পারছে, বলুক! ও সব কথার কোনও গুরুত্ব নেই।” প্রশ্নের জবাবে মান্নানের দাবি, মুকুলবাবুর বাড়ি গিয়ে তিনি কোনও বৈঠকই করেননি। রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বরে একটি বিবাহ অনুষ্ঠানে মুকুলবাবুর সঙ্গে তাঁর সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা হয়েছে মাত্র। এর থেকে অন্য অর্থ খোঁজা ঠিক হবে না।
তবে যৌথ আন্দোলনের প্রশ্নে অধীর-শিবিরের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছে মানসবাবুর। সবংয়ের বিধায়ক মানসবাবুর ব্যাখ্যা, একশো দিনের প্রকল্প সনিয়া তথা কংগ্রেসের সন্তান। সেই প্রকল্পে কাটছাঁট হলে গরিব মানুষের জীবন বিপন্ন হবে। এই অবস্থায় ব্যক্তিগত ভাবে উদ্যোগী হয়ে আন্দোলনের জন্য তিনি কংগ্রেস সভানেত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। মানসবাবুর কথায়, “বিজেপি সরকারের এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী শক্তির একজোট হওয়ার কথা বলেছিলাম। হতে পারে, এই সোজাসাপটা কথা বুঝতে কারও অসুবিধা হয়েছে! এর মধ্যে থেকে তৃণমূলের প্রসঙ্গটা বার করে নিয়ে একটা ভুল ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।” মানসবাবুর ঘনিষ্ঠ মহলের আরও বক্তব্য, তাঁর প্রস্তাবে সিপিএম-ও আপত্তি করেনি। তা হলে কি মানসবাবু সিপিএমের সঙ্গেও যোগসাজশ রেখে চলছেন বলে ধরে নিতে হবে!
কিন্তু মানসবাবু এমন ব্যাখ্যা দিলেও কংগ্রেস সূত্রের খবর, দুই ঘটনা নিয়েই প্রদেশ সভাপতি যতেষ্ট অসন্তুষ্ট। তাঁর বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেসের সংগঠন এখন শুধরোতে হবে। কেন্দ্র ও রাজ্য উভয়ের বিরুদ্ধেই আন্দোলন চালাবে কংগ্রেস। কেন্দ্র যেমন একশো দিনের কাজের প্রকল্পে নিয়ম পরিবর্তন করে মানুষের অসুবিধা সৃষ্টি করছে, তেমনই রাজ্যও কম যায় না! একশো দিনের কাজের প্রকল্পে রাজ্যে শাসক দলের দুর্নীতির কথাও সুবিদিত। প্রকল্প রূপায়ণে অনিয়ম ও বিলম্ব নিয়ে ইউপিএ সরকারের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের তরফে রাজ্যকে বহু বার সতর্ক করা হয়েছিল। এই অবস্থায় যৌথ আন্দোলনের প্রশ্ন উঠছে কোথা থেকে! মানসবাবু অবশ্য জানিয়েছেন, প্রদেশ সভাপতি কলকাতায় ফিরলে গোটা বিষয়টি নিয়েই তাঁর সঙ্গে কথা হবে।
প্রদেশ সভাপতি পরিবর্তনের পরেও আন্দোলনে যে কংগ্রেসকে সে ভাবে দেখা যাচ্ছে না, তা নিয়েও অবশ্য দলের অন্দরে প্রশ্ন আছে। কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেওয়ার হিড়িকেও দলের অনেকে চিন্তিত। যদিও অধীর বলছেন, “যে নেতারা তৃণমূলে যেতে চাইছেন, তাঁদের তো ধরে-বেঁধে রাখতে পারব না। ওঁরা তৃণমূলে গিয়ে দেখুন সেটা সবুজ ক্ষেত না ফণিমনসার ঝোপ!”