সুযোগ সত্ত্বেও অধরাই বেআইনি অটোর শাসন

পরিবহণ দফতরের নিয়মে রাস্তায় অটো নামাতে হলে সাতটি কাগজ প্রয়োজন। তার কোনও একটি কাগজ না থাকলে সেই অটো বেআইনি। পরিবহণ দফতরের মতে, শুধু কলকাতা ও শহরতলি এলাকাতেই এখন ১২ হাজারের বেশি বেআইনি অটো চলে!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২৪
Share:

আইন ভাঙা অবাধে। অটোর সামনে দুই যাত্রী। শনিবার গড়িয়ায়। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল।

পরিবহণ দফতরের নিয়মে রাস্তায় অটো নামাতে হলে সাতটি কাগজ প্রয়োজন। তার কোনও একটি কাগজ না থাকলে সেই অটো বেআইনি। পরিবহণ দফতরের মতে, শুধু কলকাতা ও শহরতলি এলাকাতেই এখন ১২ হাজারের বেশি বেআইনি অটো চলে!

Advertisement

সরকার জানাচ্ছে, রেজিস্ট্রেশন, রুট পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, পথ-কর মেটানোর রসিদ, দূষণ শংসাপত্র, বিমা সংক্রান্ত নথি এবং চালকের বৈধ লাইসেন্স — এই সাতটি কাগজের কোনও একটি না থাকলেই সেই অটোকে বাজেয়াপ্ত করতে পারে পরিবহণ দফতর। এ ছাড়া কাটা গ্যাস ব্যবহার করলে, কাটা রুট বা অন্য রুটে অটো চালালেও তা অবৈধ হিসেবেই ধরা হয়। এমন ক্ষেত্রে পরিবহণ দফতরের অভিযোগের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট অটো চালক এবং অটো মালিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে পারে পুলিশ।

প্রশাসন সূত্রে খবর, বছর চারেক আগে পরিবহণ দফতরের যুগ্মসচিব আশিস ঠাকুরের কমিটি যে রিপোর্ট দিয়েছিল, সেখানে কলকাতা শহরে বেআইনি অটোর সংখ্যা বলা হয়েছিল ১২ হাজার। এখন পরিবহণ দফতরও সংখ্যাটা একই বলছে। তার মানে, গত চার বছরে বেআইনি অটোর বিরুদ্ধে যে কার্যত কোনও ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বেআইনি অটো বাতিল করতে হবে বলে কলকাতা হাইকোর্ট বার বার নির্দেশ দিয়েছে রাজ্যকে। কিন্তু অটোকে কোনও ভাবেই লাগাম পড়ানো যায়নি। আদালতের নির্দেশ কবে কার্যকর হবে, তা বলতে পারছে না পরিবহণ দফতরও!

Advertisement

ফল যা হওয়ার, তাই হচ্ছে। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অটোকে নিয়ন্ত্রণই করতে পারছে না পুলিশ-প্রশাসন। পারমিট থাকা ৪০ হাজার আর অবৈধ ভাবে চলা ১২ হাজার অটো নিত্য দিন শহর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যাত্রীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, নির্দিষ্ট রুট না মানা, তারস্বরে গান চালানো, সিগন্যাল ভাঙা, রাস্তার যত্রতত্র দাঁড়িয়ে পড়া, নানা অজুহাতে বেশি ভাড়া চাওয়া— এককথায় যান-শাসনের দফারফা করে দিচ্ছে অটো। শহরের রাস্তায় অটোর এই চোখ রাঙানির জন্য পুলিশ-প্রশাসন ও শাসক দলের ইউনিয়নের দিকেই আঙুল তুলেছেন যাত্রীরা। মুখ্যমন্ত্রী সব সময় নিয়ম এবং আইন মেনে চলার নির্দেশ দিলেও অটোর দৌরাত্ম্য কোন রহস্যজনক কারণে আটকানো যাচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।

শুক্র ও শনিবার মিলিয়ে একটি দুর্ঘটনা-সহ তিনটি অনিয়মের ঘটনায় যে রাজ্য সরকার বেশ বিব্রত, তা পরিষ্কার রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের কথাতেই। শুক্রবার খাদ্যমন্ত্রীর সামনেই একটি ঘটনা ঘটে। এ প্রসঙ্গে শনিবার জ্যোতিপ্রিয়র দাবি, ‘‘অটো চালকদের মাত্র ২০ শতাংশের জন্য বদনাম হচ্ছে। মানুষ ওঁদের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। অটো ইউনিয়নের নেতাদের উচিত, ওই ২০ শতাংশ অটো চালককে প্রশিক্ষণ দেওয়া।’’

রাজ্য সরকার এ বারে কি কিছু করবে? খাদ্যমন্ত্রীর জবাব, ‘‘২৫ সেপ্টেম্বর পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী অটো নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন। সে দিন সিদ্ধান্ত হতে পারে।’’ স্বেচ্ছাচারী অটোচালক ও অটো মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রসঙ্গে পরিবহণ দফতরের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘বিষয়টি স্পর্শকাতর। এটা একটা সামাজিক সমস্যাও বটে। তাই ভেবেচিন্তে ব্যবস্থা নিতে হবে।’’

শুক্র ও শনিবার কী ঘটেছে? শুক্রবার সকালে উত্তর কলকাতার গৌরীবাড়িতে সিগন্যাল ভেঙে ছুটতে গিয়ে একটি অটো বাসে ধাক্কা মারলে চালকের পাশে বসা এক ছাত্রীর ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয়। ওই দিন দুপুরেই মির্জা গালিব স্ট্রিটে খাদ্য ভবনের গেট আটকে দাঁড়িয়ে পড়া অটোচালকেরা খোদ খাদ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তর্ক জুড়ে দেন। মন্ত্রীর এক নিরাপত্তা রক্ষীকে ধাক্কাও মারেন এক চালক। ওই একই জায়গায় শনিবার দুপুরে এক হোমগার্ডকে রাস্তায় ফেলে মারধর করার অভিযোগ উঠেছে অটো চালকদের বিরুদ্ধে। শুক্রবারের ঘটনায় কেউ ধরা না পড়লেও শনিবার গ্রেফতার করা হয়েছে অভিযুক্ত অটো চালককে।

দিনের পর দিন তাণ্ডব চালিয়ে যাওয়া এই বেপরোয়া কুশীলবদের মাথার উপর যারা রয়েছে, সেই অটো ইউনিয়নগুলি কী বলছে?

বাম জমানায় মহানগরীর অটোরুটগুলি নিয়ন্ত্রণ করত সিটু। এখন করে তৃণমূল আশ্রিত আইএনটিটিইউসি। এই সংগঠনের কলকাতা জেলা সভাপতি মেঘনাদ পোদ্দারের কথায়, ‘‘নিয়ম মেনে অটো চালানোর জন্য আমরা বহু বার মিটিং করেছি। কিন্তু কলকাতায় অসংখ্য অটো চলে। সব অটোতে নজর রাখা সম্ভব নয়।’’

মেঘনাদবাবুর অবশ্য দাবি, ‘‘পরিস্থিতি আগের থেকে উন্নত হয়েছে।’’ কী ভাবে? তাঁর মন্তব্য, ‘‘এখন যে কোনও রুটের অটো যাত্রী আমাদের অভিযোগ জানালে তা খতিয়ে দেখা হয়। দরকার হলে সেই চালকের অটো চালানো বন্ধ করে দেওয়া হয়।’’ শুক্রবার গৌরীবাড়ির ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘‘এর পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, তার জন্য ২২ সেপ্টেম্বর বৈঠক ডাকা হয়েছে।’’

সিটু নেতা অজিত চৌধুরী আবার অটোর এই দৌরাত্ম্যের জন্য দায়ী করেছেন স্ট্যান্ডের দাদাদের। তাঁর দাবি, ‘‘অটোস্ট্যান্ডে নেতারা চালকদের থেকে নিয়মিত পয়সা নেন। তাই সেই স্ট্যান্ডের কোনও চালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাঁকে শাস্তির হাত থেকে ‘বাঁচানো’র দায়িত্ব নেন ওই দাদাই।’’

সিসিটিভি ক্যামেরা, হাই-সিকিউরিটি নম্বরপ্লেট— এ সবের দৌলতে বেআইনি কাজ করা অটোকে চিহ্নিত করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয় বলেও মন্তব্য করেন অজিতবাবু। তিনি বলেন, ‘‘অটোর চালককে ডেকে সতর্ক করা বা শাস্তি দেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু প্রশাসন ততটা সক্রিয় নয় এ ব্যাপারে। কখনও সক্রিয় হলেও সামনে এসে যান স্ট্যান্ডের সেই দাদারা।’’

অটোর দৌরাত্ম্যের কথা মেনে নিয়ে ডিসি (ট্রাফিক) ভি সলেমান নিশাকুমার বলেন, ‘‘বেপরোয়া অটোচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের তরফে ‘কেস’ করার পাশাপাশি অটোচালকদের শিক্ষামূলক কর্মশালার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আগের থেকে দৌরাত্ম্য কমলেও দুর্ঘটনা থামছে না। আগামী দিনে আরও সতর্ক হব।’’

কেউ বলছেন বৈঠকের কথা, কেউ সতর্ক হওয়ার কথা। কিন্তু কাজের কাজ আদৌ হবে কি?

বৈধতার শর্ত

রেজিস্ট্রেশন

রুট পারমিট

ফিটনেস সার্টিফিকেট

পথ-কর

দূষণ শংসাপত্র

বিমা সংক্রান্ত নথি

চালকের বৈধ লাইসেন্স

কাটা গ্যাস, কাটা রুট বা অন্য রুটে অটো চললেও তা অবৈধ

কলকাতা ও শহরতলিতে বেআইনি অটো ৫২ হাজার ও ১২ হাজার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন