অবশেষে মাথার উপরে একটি উপদেষ্টা কমিটি বসিয়ে শঙ্কুদেব পণ্ডা এবং তাঁর টিএমসিপিকে লাগাম পরানোর চেষ্টায় নামলেন তৃণমূল নেতৃত্ব।
এর আগে শিক্ষামন্ত্রী একাধিক বার সতর্ক করে সংযত হতে বলেছেন। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক প্রশ্ন তুলেছেন, ছাত্র সংগঠনের জন্য কেন শাসক দলকে অস্বস্তিতে পড়তে হবে! কিন্তু কিছুতেই রাশ টানা যায়নি টিএমসিপি-র। সংগঠনের রাজ্য সভাপতি শঙ্কুদেব পণ্ডার নেতৃত্বে রাজ্যের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র রাজনীতির বিশৃঙ্খলা কার্যত নজিরবিহীন মাত্রা ছুঁয়েছে বলে অভিযোগ। টিএমসিপি-র কার্যকলাপে কিছুটা রাশ টানতেই এ বার উপদেষ্টা কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত, এমনই খবর তৃণমূলের অন্দরে।
এই কমিটি গঠিত হওয়ায় ভবিষ্যতে শঙ্কুদেবের একার সিদ্ধান্তে টিএমসিপি বিশেষ কিছু করতে পারবে না।
কোনও কর্মসূচি নিলেও উপদেষ্টা কমিটিতে তার পর্যালোচনার সুযোগ থাকবে। ফলে, সংগঠনের কার্যকলাপ কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হবে বলে আশা তৃণমূল নেতৃত্বের।
বুধবার গঠিত ওই কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন যুবকল্যাণ মন্ত্রী, তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অরূপ বিশ্বাস। দলের অন্দরে যাঁর সঙ্গে শঙ্কুদেবের ঘনিষ্ঠতার কোনও খবর নেই! সেই সঙ্গে তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের পরিষদীয় সচিব অশোক দেব ও তাপস রায়, তৃণমূলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়, আলিপুরদুয়ার জেলা তৃণমূলের সভাপতি সৌরভ চক্রবর্তী ও ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি রাহুল রায় পুরনো ছাত্র পরিষদের প্রাক্তন ছাত্র নেতাদের এই কমিটিতে রাখা হয়েছে। আগে বৈশ্বানর একক ভাবে উপদেষ্টা-চেয়ারম্যান ছিলেন। এঁদের কারও সঙ্গেই শঙ্কুদেব ও তাঁর অনুগামীদের সম্পর্ক খুব একটা মধুর নয়। টিএমসিপি-কে ‘পরামর্শ দেওয়া ও নজরদারি’র জন্য গঠিত কমিটিতে এই সদস্যদের রাখায় স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠেছে, এ কি শঙ্কুদেবের ডানা ছাঁটার উদ্যোগ?
শঙ্কুদেব নিজে এর জবাবে বলেন, “এই প্রশ্নে তো অন্তত এটুকু প্রমাণিত হল যে, আমার ডানা আছে! আর তা একেবারে কেটে না ফেলে ছাঁটার চেষ্টা হচ্ছে!” তা হলে কি তিনি এই উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হওয়ায় কিছুটা চাপে? শঙ্কু বলেন, “মোটেই না। যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই প্রাক্তন ছাত্রনেতা। কমিটিকে স্বাগত। কমিটির উপদেশ পাথেয় করেই ভবিষ্যতে এগোব।” সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান অরূপবাবু অবশ্য কোনও বিতর্কে যেতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “আমি দলের অনুগত সৈনিক। দল যে দায়িত্ব দেবে, তা-ই পালন করব।”
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংগঠনের দৌরাত্ম্য বরদাস্ত করা হবে না বলে বেশ কয়েক বার কড়া বার্তা দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। তাতে তেমন সাড়া না মেলায় সম্প্রতি কলেজের অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের চাপের কাছে মাথা নত না করার পরামর্শও দিয়েছেন পার্থবাবু। তিনি এবং তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় সম্প্রতি তৃণমূল ভবনে টিএমসিপি-র সদস্যদের এক বৈঠকে সংগঠনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সংযত হওয়ার বার্তা দেন। সেখানেই মুকুলবাবু প্রশ্ন তোলেন, টিএমসিপি-র জন্য দলকে কেন বারবার অস্বস্তিতে পড়তে হবে?
গত ২৮ অগস্ট টিএমসিপি-র প্রতিষ্ঠা দিবসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ছাত্র সংগঠনকে সংযত হওয়ার কোনও বার্তাই কার্যত দেননি। প্রশ্ন উঠেছিল, এ ভাবে কি টিএমসিপি-কে প্রশ্রয় দিলেন মমতা? যদিও টিএমসিপি-রও একটা বড় অংশ নানা কারণে শঙ্কুদেবের উপরে বিরক্ত বলে ওই সংগঠন সূত্রেরই খবর। শেষ পর্যন্ত উপদেষ্টা কমিটি গড়ে টিএমসিপি সভাপতির একচ্ছত্র ক্ষমতাই খানিকটা খর্ব করা হল বলে মনে করছেন সংগঠনেরই অনেকে।
মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলার জন্যই সম্প্রতি বারবার শিরোনামে এসেছে টিএমসিপি। কখনও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট বৈঠকের বাইরে বহিরাগতদের নিয়ে শঙ্কুর হাততালি দিয়ে স্লোগান, কখনও টুকতে দেওয়ার দাবিতে নদিয়ার বাঙালঝি কলেজের অধ্যক্ষকে নিগ্রহ, কখনও বা ভক্তবালা বিএড কলেজে মোটা টাকার বিনিময়ে ছাত্র ভর্তির অভিযোগ। শিক্ষামেলার নাম করে আর্থিক তছরুপের অভিযোগও উঠেছে টিএমসিপি-র বিরুদ্ধে।
এমনকী গত সপ্তাহেই কলেজের ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়া জানানোর জন্য একটি ওয়েব পোর্টাল খোলার কথা ঘোষণা করেছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাস। এর পরেই শঙ্কুদেব পাল্টা ঘোষণা করেন, তাঁরা একটি হটলাইন চালু করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনেট পদ্ধতির তুলনায় যা অনেক দ্রুততার সঙ্গে কাজ করবে। এক ঘণ্টার মধ্যে ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা মিটিয়ে দেওয়া যাবে এই হটলাইনের সাহায্যে।
বিভিন্ন সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে এ রকম টক্কর দেওয়ার প্রবণতা এবং কথায় কথায় তাঁদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির যে নজির টিএমসিপি স্থাপন করেছে, তা তৃণমূলের অনেক শীর্ষ নেতাই ভাল ভাবে নেননি। সেই সব দিক বিচার করেই এ বার উপদেষ্টা কমিটি গড়ল শাসক দল।