পরিবর্তনের প্রবল হাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে হয়েছিল ৬২। আসছে বছর কী হবে?
বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক মাস দূরত্বে দাঁড়িয়ে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চাইছে আলিমুদ্দিন। প্রশ্নটা তাদের ভাবাচ্ছে, কারণ কলকাতায় আগ্রাসী অভিযান বা জেলায় বড় সমাবেশে ভিড় হলেও তৃণমূল স্তরে সিপিএম কর্মীদের আড় এখনও ভাঙেনি! জেলা সদর বা কলকাতায় এসে যাঁরা দলের কর্মসূচিতে যোগ দিচ্ছেন, তাঁদের একটা বড় অংশই এখনও নিজেদের পাড়ায় তৃণমূলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কাজ করতে পারছেন না।
সিপিএমের এক রাজ্য নেতার কথায়, ‘‘সমাবেশে ভিড় হচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সেগুলো বেশির ভাগ জেলা বা রাজ্য স্তরের কেন্দ্রীয় জমায়েত। গ্রাম পঞ্চায়েত বা ওয়ার্ডে কর্মসূচি নিলে এখনও সেই উদ্দীপনা চোখে পড়ছে না। অথচ ভোটের মূল লড়াইটা বুথেই হবে।’’ উদাহরণ হিসাবে উঠে আসছে পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির কথা। সেই ২০০৭ সাল থেকেই সেখানে বামেদের স্বাভাবিক কাজকর্ম প্রায় বন্ধ। নবান্ন অভিযান বা ব্রিগে়ড সমাবেশের ডাক দিলে খেজুরি থেকে যত লোক আসছেন, খেজুরিতে কর্মসূচি নিতে বললে তত লোক এখনও বেরোনোর সাহস করছেন না!
উপর ও নীচের এই ব্যবধান আঁচ করেই জেলায় জেলায় ফের বাস্তব পরিস্থিতি যাচাই করতে তথ্য চাইছেন সিপিএমের রাজ্য নেতৃত্ব। পুজোর পরে বর্ধিত রাজ্য কমিটির বৈঠক ডেকেও সাংগঠনিক হালহকিকত চর্চা করা হবে। কয়েক মাস আগের পুরভোটে সাম্প্রতিক কালের মধ্যে প্রথম বার বামেদের ভোটব্যাঙ্কে রক্তক্ষরণ বন্ধের ইঙ্গিত মিলেছে। হালফিল নবান্ন বা লালবাজার অভিযানে রাস্তায় নেমে আগ্রাসী আন্দোলনের চেহারা দেখানো গিয়েছে। তবু এ সব ‘ইতিবাচক’ লক্ষণ ভোটবাক্সে গিয়ে পৌঁছবে কি না, তা নিয়ে সংশয় এখনও কাটছে না সিপিএম নেতৃত্বের।
শিলিগুড়ি পুরসভার পরে মহকুমা পরিষদেও বামফ্রন্টের জয় সম্প্রতি আলিমুদ্দিনের মনোবল বাড়িয়েছে। কিন্তু বিধাননগর, আসানসোল ও বালির পুরভোটে তেমন কিছু প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায়নি। আলিমুদ্দিনের হাতে অবশ্য এখনও শিলিগুড়ি বা বিধাননগর, কোনও নির্বাচনেরই বিশদ তথ্য আসেনি। কিন্তু প্রাথমিক পর্যালোচনায় রাজ্য নেতৃত্ব বুঝতে পারছেন, সংগঠনে নানা ফাঁকফোকর রয়েই যাচ্ছে। এখন থেকে যা বোজাতে চেষ্টা না করলে বিধানসভা ভোটে দুশ্চিন্তা আছে!
ডিসেম্বরের শেষে কলকাতায় সিপিএমের সর্বভারতীয় সাংগঠনিক প্লেনাম বসবে। সেই বিশেষ অধিবেশন উপলক্ষে জেলা হয়ে একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত সংগঠনের হাল বুঝতে বিশদ প্রশ্নপত্র তৈরি করে পাঠিয়েছিল পলিটব্যুরো। প্রশ্নপত্র ভর্তি করে ফেরত গিয়েছে পলিটব্যুরোর কাছে। তার ভিত্তিতে প্লেনামের খসড়া রিপোর্ট পেশ করা হবে আগামী ১৩ নভেম্বর থেকে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির চার দিনের বৈঠকে। এই তথ্য সংগ্রহ এবং তার পরেও জেলায় বৈঠক করতে গিয়ে রাজ্য নেতারা বুঝতে পারছেন, বহু ক্ষেত্রেই সংগঠনের মরচে এখনও তোলা যায়নি! এই পরিস্থিতি মাথায় রেখেই বুথ সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলতে দলের অন্দরে বারংবার নির্দেশিকা জারি করছেন সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। বুথ স্তরে প্রতিরোধ গড়তে না পারলে অবস্থা যে বিধাননগরের পুরভোটের মতোই হবে, তা বিলক্ষণ জানেন সূর্যবাবুরা। তাই হাতে সময় থাকতেই বুথ কমিটি গড়া এবং অন্য দিকে ভাল লড়াই করার জায়গা আছে, এমন সম্ভাব্য বিধানসভা আসনগুলি চিহ্নিত করে নিতে চাইছে সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্যের বক্তব্য, ‘‘উত্তরবঙ্গের ৭৬টি বিধানসভা আসনেই ভাল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে বলে আশা করা যায়। কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে এবং সুষ্ঠু ভোট হলে দক্ষিণবঙ্গেও অনেক জায়গায় হাড্ডাহা়ড্ডি লড়াই হবে।’’
পরপর পুরভোটে বিজেপি-র হাওয়া ঝিমিয়ে পড়ার পরে তৃণমূলের সঙ্গে বামেদেরই মুখোমুখি লড়াই হবে ধরে দলের কর্মী-সমর্থকদের উজ্জীবিত করতে চাইছে আলিমুদ্দিন। তবে দলেরই একাংশের প্রশ্ন, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, কলকাতার মতো যে সব জেলায় সিপিএমের এখন কোনও বিধায়কই নেই, সেই সব এলাকার জন্য বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে কোনও পরিকল্পনা এখনও নেওয়া হচ্ছে না কেন? জেলার এক সিপিএম নেতার কথায়, ‘‘মিটিং-মিছিলে কত লোক হল, তা-ই দিয়ে তো কেউ কোনও দলের শক্তি মনে রাখে না। শক্তি মাপা হয় ভোটের শতাংশ হিসাব দিয়েই। সে সব ভাবার বদলে আমেরিকা, জাপানের সঙ্গে ভারতের ত্রিদেশীয় মহড়ার বিরুদ্ধে মিছিল করে সময় নষ্ট করলে আর কী হবে!’’