রঘুনাথপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। নিজস্ব চিত্র
কয়লা বেশি এলেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়বে। তাই কয়লার আমদানি বাড়িয়ে দিয়েছিল ডিভিসি। কিন্তু, তারপরেও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়েনি। তাতেই খটকা লাগে ডিভিসি কর্তৃপক্ষের। তবে কি কয়লার মধ্যেই যত গোলমাল?
তদন্তে নেমে পড়েন সংস্থার ভিজিল্যান্স দফতরের কর্মীরা। সংস্থার অভ্যন্তরীণ তদন্তও শুরু হয়ে যায়। তারপরেই কয়লার মান নিয়ে গোলমালে জড়িত থাকার অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হল দুই কর্তার বিরুদ্ধে। তা নিয়েই জোর চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে কর্মীমহলে।
তাঁরা জানাচ্ছেন, ডিভিসি রঘুনাথপুরের বিদ্যুৎকেন্দ্র নিজেদের হাতে রাখবে কি না, তা নিয়েই এক সময়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল। পরে লোকসানের বোঝা নামিয়ে লাভের মুখ দেখা ডিভিসি রঘুনাথপুরের বিদ্যুৎ যখন বাইরে বিক্রির চেষ্টা শুরু করেছে, সেই সময়েই এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লার মান নিয়ে এই গোলমাল সামনে এল।
ডিভিসির দাবি, আগে শুধু সড়ক পথেই ঝাড়খণ্ড থেকে কয়লা নিয়ে আসা হচ্ছিল। গত কয়েক মাস ধরে কিছু পথ ট্রেনে ও বাকি পথ সড়কে ট্রাকে কয়লা আসছে। তখনই গোলমাল বাধে। এক কর্তার দাবি, ‘‘খনি থেকে আসছে উন্নতমানের কয়লা। কিন্তু, বিদ্যুৎকেন্দ্রে যখন কয়লার ট্রাক ঢুকছে, তখন দেখা যাচ্ছিল, মান ভাল নয়। কখনও বা কয়লার মধ্যে মিশে থাকছিল পাথর। পরিমাণেও গরমিল পাওয়া যাচ্ছিল। এরপরেই সংস্থার কর্তারা নড়েচড়ে বসেন।’’
ডিভিসির চেয়ারম্যান প্রদীপকুমার মজুমদার বলেন, ‘‘নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতেই প্রকল্পের অধিকর্তা ও ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদমর্যাদার এক জনকে সাসপেন্ড করা হয়েছে।’’ জানা গিয়েছে, তাঁদের এক জনকে ডিভিসির সদর দফতর কলকাতায়, অন্য জনকে ঝাড়খণ্ডের বোকারোর বিদ্যুৎকেন্দ্রে বদলি করা হয়েছে। ডিভিসি সূত্রে জানা গিয়েছে, রঘুনাথপুরের প্রকল্প অধিকর্তা হিসাবে দায়িত্ব নিচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের কোডরমার চিফ ইঞ্জিনিয়ার অনন্ত চক্রবর্তী, মাইথন থেকে ওই ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার পদে আসছেন একে সিংহ। ডিভিসির চেয়ারম্যানের দাবি, ‘‘রঘুনাথপুরের প্রকল্প থেকে পূর্ণমাত্রায় উৎপাদন করাই আমাদের লক্ষ্য। কিন্তু কয়লা সংক্রান্ত বেনিয়মের জন্য রঘুনাথপুর থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় উৎপাদন পাওয়া যাচ্ছিল না।’’
কয়েক মাস আগে চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পরেই প্রবীরবাবু রঘুনাথপুরের প্রকল্পের পুনর্জীবন ঘটাতে সচেষ্ট হন। তারই ফলে আরও কয়লা আনতে সড়কপথের বদলে মালগাড়িতে অনেকটা পথ কয়লা নিয়ে আসার তোড়জোড় শুরু হয়। আগে দৈনিক পাঁচ হাজার মেট্রিক টন কয়লা আসছিল। তাতে একটি ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল। ডিভিসির এক পদস্থ কর্তা জানান, পরে নিতুড়িয়ার চৌরাশি, পাড়ার রুকনি ও আসানসোলের রাধানগর স্টেশনের সাইডিংয়ে মালগাড়িতে কয়লা আনা শুরু হয়। সেখান থেকে ট্রাকে বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লা আসা শুরু হয়। তাতে দৈনিক কয়লা আমদানি ১২ হাজার মেট্রিক টন হওয়ার কথা ছিল। এপ্রিল মাসের মধ্যেই ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে আশাবাদী ছিলাম আমরা।’’ কিন্তু মার্চ মাস থেকে মালগাড়ি ও ট্রাকে কয়লা নিয়ে আসা শুরু হলেও প্রত্যাশিত মাত্রায় উৎপাদন শুরু হয়নি।
কী ভাবে কয়লা বদলে যাচ্ছিল?
ডিভিসির একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, তদন্তে জানা গিয়েছে, দু’ধরনের বেনিয়ম তাদের নজরে এসেছে। প্রথমত, খনি থেকে যে মানের কয়লা পাঠানো হচ্ছিল, বিদ্যুৎকেন্দ্রে শেষ পর্যন্ত সেই মানের কয়লার বদলে কিছুটা নিম্নমানের কয়লা আসছিল। দ্বিতীয়ত দৈনিক যে পরিমাণ কয়লা আসার কথা, তার থেকে কম আসছিল। দাবি করা হচ্ছে, মালগাড়ি থেকে কয়লা নামানোর সময়ে কিছু চুরি করা হচ্ছিল। পাশাপাশি সড়কপথে নিয়ে আসার সময়ে অন্তত আট থেকে দশটি জায়গায় ট্রাক থামিয়ে ভাল মানের কয়লা নামিয়ে বদলে নিম্নমানের কয়লা, কখনও বা পাথর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছিল। স্থানীয় কয়লা মাফিয়ারাই এই কাজ করিল বলে জানা গিয়েছে।
চেয়ারম্যান বলেন, ‘‘সংস্থার অন্দরে তৈরি হওয়া বহু জটিলতা কাটিয়ে ডিভিসি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। গত চার মাসে দেশের বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বেড়েছে। লাভের মুখ দেখছে সংস্থা। এই অবস্থায় কোনও রকম বেনিয়ম বরদাস্ত করা হবে না বলেই রঘুনাথপুরের প্রকল্পের দুই আধিকারিকের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
তবে রঘুনাথপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে, কয়লা সংক্রান্ত দুর্নীতি সামনে আসা মাত্রই প্রকল্প অধিকর্তা রঘুনাথপুর থানায় নির্দিষ্ট কয়েকটি ট্রাক চালকের বিরুদ্ধে কয়লাচুরির অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। কয়লা সরবরাহের বরাতপ্রাপ্ত ঠিকা সংস্থার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করার প্রস্তাবও তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠিয়েছিলেন।