বঞ্চনার অভিযোগ, কীর্তনিয়া-বাউলরা আজ রাস্তায়

কয়েকশো বছর ধরে তাঁরা বাংলার গ্রামেগঞ্জে সহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করে আসছেন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বঞ্চনার অভিযোগ তুলে সেই কীর্তন শিল্পী, সুফি ও বাউলরা এ বার কলকাতার রাস্তায় নামছেন বিক্ষোভ দেখাতে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১২
Share:

কয়েকশো বছর ধরে তাঁরা বাংলার গ্রামেগঞ্জে সহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করে আসছেন। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও বঞ্চনার অভিযোগ তুলে সেই কীর্তন শিল্পী, সুফি ও বাউলরা এ বার কলকাতার রাস্তায় নামছেন বিক্ষোভ দেখাতে। প্রয়োজনে আমরণ অনশনে বসার হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন তাঁরা। শিল্পীদের অভিযোগ— সরকারের মন্ত্রী-আমলা ও শাসক দলের নেতাদের কাছে দিনের পর দিন দরবার করে চাট্টি মনভোলানো কথা ছাড়া চার বছরে কিছুই মেলেনি। দুঃস্থ শিল্পীদের ভাতা দেওয়ার নামে তাঁদের নিয়ে রাজনীতি হয়েছে। অনটন তাঁদের নিত্যসঙ্গী। বৃদ্ধ বয়সে অনেকেই মারা যাচ্ছেন চরম দুরবস্থায়। কেউ কেউ অত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন।

Advertisement

অসহিষ্ণুতা বিতর্কে উত্তাল দেশ। কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতার অভিযোগ তুলে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন শিল্পী-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-ইতিহাসবিদেরা। অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদে সরব হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এ রাজ্যের নগরজীবন থেকে প্রত্যন্ত পল্লী-মানস— ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে নিজেদের গানের মাধ্যমে প্রচার করে এসেছেন কীর্তনিয়ারা। সর্বধর্ম সমন্বয়ের কথা বলে আসছেন সুফি ও বাউল সম্প্রদায়। কিন্তু তাঁদের ক্ষোভ— কী সমাজ, কী সরকার, ভিখারির বেশি মর্যাদা তাঁদের কেউ দেয় না! জিয়াগঞ্জের কীর্তনিয়া রাধারানি দেবীর পরিচিতি ছিল দেশজোড়া। শেষ বয়সে হারমোনিয়াম বিক্রি করে ভাত জোটাতে হয় তাঁকে। চরম দারিদ্রে মারা যাওয়ার আগে প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারীকে সরকারের কাছে আর্জি জানাতে হয়— ‘তোমাদের পদকে পেট ভরে না। পদক ফেরত নিয়ে কিছু অর্থসাহায্যের বন্দোবস্ত করুন।’ বৃদ্ধ বয়সে গাইবার সামর্থ চলে গেলে ভিক্ষাজীবী হয়ে কাটাতে হয় অনেক শিল্পীকে। সারা ভারত কীর্তন ও ভক্তিগীতি সংসদের সম্পাদক সিদ্ধার্থশেখর দাস বলেন, ‘‘আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। মন্ত্রী-সান্ত্রী-নেতাদের কাছে ঘুরে ঘুরে জুতো ক্ষয়ে গিয়েছে। শুকনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া ছাড়া কেউ কিচ্ছু করেনি।’’ কী চান তাঁরা? সিদ্ধার্থবাবু বলেন, ‘‘আর কিচ্ছু নয়, একটু স্বীকৃতি। আর বৃদ্ধ শিল্পীদের দিন গুজরানের জন্য যৎসামান্য মাসোহারা, বিমা ও চিকিৎসার সুযোগ। প্রতি জেলায় একটি করে কীর্তনের স্কুল।’’ এই কীর্তনিয়ার অভিযোগ, তাঁরা রাজনীতিতে জড়াতে চান না। কিন্তু তাঁদের নিয়ে রাজনীতি করছে রাজ্য সরকার।

সেটা কী রকম? সরকারের ‘লোকশিল্প প্রসার প্রকল্প’ কর্মসূচি চালু হয়েছে। বলা হয়েছে, জেলায় জেলায় প্রকৃত লোকশিল্পীদের বেছে সরকারি পরিচিত পত্র দেওয়া হবে। তাঁরা মাসোহারা পাবেন, পাবেন অন্য সুবিধাও। কীর্তন ও ভক্তিগীতি সংসদের সহ-সভাপতি ভাস্কর নস্কর বলেন, ‘‘প্রকৃত শিল্পী— কীর্তনিয়া, সুফি, বাউলের সংখ্যা রাজ্যে প্রায় এক কোটি। তাঁদের মধ্যে সরকারি পরিচিতি পত্র পেয়েছেন হাজার দু’য়েক। তাঁদের মাসোহারা শুরু যেমন হয়েছিল, বন্ধও হয়ে গিয়েছে সরকারের টাকা নেই বলে।’’ সম্পাদক সিদ্ধার্থবাবু জানান, সংসদ সরকারকে পরামর্শ দিয়েছিল, ঢালাও বিলির বদলে কেবল দুঃস্থ বৃদ্ধদের মাসোহারার ব্যবস্থা হোক। কিন্তু তা যাতে নিয়মিত দেওয়া যায়, তা নিশ্চিত করুক সরকার। তাঁর দাবি, সংসদের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০ লক্ষ। কারা পরিচিতি পত্র ও মাসোহারা পাবেন, সংসদের সঙ্গে আলোচনা করেই সরকার ঠিক করুক। কিন্তু সিদ্ধার্থবাবুর অভিযোগ, পঞ্চায়েত সদস্যরাই শিল্পী বাছছেন। তাতে যা-হওয়ার সেটাই হয়েছে।

Advertisement

সংসদের নেতারা জানান, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে অনেক বার সময় চেয়েছেন তাঁরা। নবান্ন সাড়া দেয়নি। সহ-সভাপতি ভাস্কর নস্কর বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী কবিতা লিখে অসহিষ্ণুতার প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিন্তু যে শিল্পীরা কয়েকশো বছর ধরে ঘরে ঘরে সহিষ্ণুতার বাণী প্রচার করে চলেছেন, তাঁদের কথা শোনার জন্য দু’দণ্ড সময় নেই তাঁর!’’ সোমবার সারা রাজ্যের কীর্তনিয়া-বাউল-সুফিরা ধর্মতলায় গাঁধী মূর্তির নীচে জমায়েত হবেন। নবান্নে যাবেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। তার পরে প্রয়োজনে এখানেই অনশনে বসবেন তাঁরা। সরকার কী সাড়া দেয়, সব কিছু তার ওপরই নির্ভর করছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন