‘ফোননম্বর দিয়ে এক দাদা বলেছে, যা লাগবে দিবি, ভর্তি করিয়ে দেব’

গত সোমবার ওই কলেজে ইংরেজি-সহ স্নাতক স্তরের বেশ কয়েকটি বিষয়ে পড়ুয়াদের কাউন্সেলিং ছিল। তাঁদের বলা হয়েছিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে কলেজে হাজির থাকতে হবে ।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০১৮ ০৪:১৬
Share:

আশুতোষ কলেজে চলছে ভর্তি-প্রক্রিয়া। ফাইল চিত্র।

সকাল ১১টা বাজতে মিনিট দশেক বাকি। পাটুলির কে কে দাস কলেজের কাউন্সেলিং রুমের বাইরে মার্কশিট হাতে তখনও জনা ১২ পড়ুয়ার লাইন।

Advertisement

ঘরের দরজা আটকে হঠাৎ এক যুবক বলতে শুরু করলেন, ‘‘সময় শেষ। আর হবে না। জায়গাটা ফাঁকা করো।’’ ঘোষণা শুনে প্রবল উত্তেজিত লাইনে অপেক্ষারতেরা। তাঁদের প্রশ্ন, ১০ মিনিট সময় বাকি থাকতেই কেন কাউন্সেলিং বন্ধ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে? নিচু গলায় যুবককে এর পর বলতে শোনা যায়, ‘‘আমাদের নম্বর নিয়ে যা। যারা ভর্তি হতে পারলি না, ফোন করিস। ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’’

গত সোমবার ওই কলেজে ইংরেজি-সহ স্নাতক স্তরের বেশ কয়েকটি বিষয়ে পড়ুয়াদের কাউন্সেলিং ছিল। তাঁদের বলা হয়েছিল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে ১১টার মধ্যে কলেজে হাজির থাকতে হবে । অভিযোগ, ১১টার আগেই ভর্তি প্রক্রিয়া বন্ধ করিয়ে দিয়েছেন ছাত্রনেতারা। এক ছাত্রীর অভিযোগ, ‘‘ফোননম্বর দিয়ে এক দাদা বলেছে, যা লাগবে দিয়ে দিবি, ভর্তি করিয়ে দেব।’’

Advertisement

যদিও বিষয়টি জানেন না ওই কলেজের অধ্যক্ষ রামকৃষ্ণ চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘কেউ অভিযোগ করেননি। করলেই ব্যবস্থা নেব।’’ আর কলেজের তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (টিএমসিপি) ইউনিট সম্পাদক সৈকত রায়ের কথায়, ‘‘আমরা ভর্তি হতে আসা ভাই-বোনেদের সাহায্য করছি মাত্র। খুব ভিড় ছিল, আর সময়ও হয়ে গিয়েছিল। তাই লাইন ফাঁকা করে দিতে বলেছি। তবে টাকা চাওয়া হয়নি।’’

চলতি বছরে ভর্তি প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে একাধিক পদক্ষেপ করেছে প্রশাসন। তবে তাতেও কলেজে কলেজে ‘ভর্তি দুর্নীতি’র ঘুঘুর বাসা ভাঙা যায়নি বলে কাউন্সেলিং শুরুর দু’দিনের মধ্যেই অভিযোগ উঠছে। সোম ও মঙ্গলবার দিনভর দক্ষিণ কলকাতার একাধিক কলেজে ঘুরে সেই ইঙ্গিত পাওয়া গেল।

ভবানীপুরের চারুচন্দ্র কলেজে এবার অনলাইনেই ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে। অন্য কলেজের মতো সেখানে আসার প্রয়োজনই নেই ভর্তি হতে চাওয়া পড়ুয়াদের। ওই কলেজের এক প্রবীণ শিক্ষক বলেন, ‘‘অনলাইনে ভর্তি হলেও কাউন্সেলিং বা রিপোর্টিংয়ের জন্য পড়ুয়াদের ভর্তির আগে এক বার অন্তত কলেজে যেতেই হচ্ছে। তখনই টাকা চাইছেন ছাত্রনেতারা। না দিলে মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও পড়ুয়াদের কাউন্সেলিং রুমে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না।’’ তাঁর দাবি, ‘‘তাই আমরা পড়ুয়াদের কলেজে আনতেই চাইছি না।’’

শুক্রবারই ছাত্র ভর্তিকে কেন্দ্র করে দীনবন্ধু অ্যান্ড্রুজ কলেজে গন্ডগোলে জড়ান দুই তৃণমূল কাউন্সিলর এবং তাঁদের অনুগামীরা। এরপর থেকে কলেজে পুলিশি প্রহরা বসিয়ে ভর্তি প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন অধ্যক্ষ সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। মঙ্গলবার ওই কলেজে গিয়ে দেখা গেল, প্রবল পুলিশি নিরাপত্তা। তবে তার মধ্যেই এক ছাত্রীকে ভর্তি করানো নিয়ে গন্ডগোল বেধে গেল ছাত্র সংসদের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। পরিস্থিতি সামাল দিল পুলিশ।

ওই ছাত্রী জানালেন, কলেজের তরফে তাঁকে মেসেজ করে জানানো হয়েছিল, দ্বিতীয় মেধা তালিকায় তাঁর নাম উঠেছে। এদিন কলেজে উপস্থিত থাকতে হবে। তবে কলেজে এসে ছাত্রী জানতে পারেন, প্রথম মেধাতালিকার ভর্তি প্রক্রিয়াই শেষ হয়নি। ফলে দ্বিতীয় মেধাতালিকা প্রকাশ করা হয়নি এখনও। তা শুনে কাঁদতে শুরু করেন ছাত্রী। তাঁর কথায়, ‘‘মেসেজ পেয়েছিলাম। এক দাদা বলল, আজই ভর্তি হতে হবে। কিন্তু, কলেজে এসে শুনি আমার নামই ওঠেনি!’’

পরে অবশ্য ওই ছাত্রীকে ভর্তি করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। যা শুনে এক ছাত্রনেতার অভিযোগ, ‘‘ওই ছাত্রী কলেজের এক নেতার ঘনিষ্ঠ। তাই ওকে বেআইনি ভাবে কলেজে ভর্তি নেওয়া হল।’’ অধ্যক্ষ সোমনাথবাবু বলছেন, ‘‘মাঝেমধ্যে ভুল হয়ে যায়। সে রকমই হয়েছে এক্ষেত্রে। ভুল মেসেজ গিয়েছিল। বাচ্চা মেয়েটার কোনও দোষ নেই।’’ তালিকায় নাম না থাকলেও এভাবে কি কাউকে ভর্তি করা যায়? উত্তর মেলেনি।

বৃহস্পতিবার আশুতোষ কলেজে গিয়ে দেখা গেল, দুপুর দেড়টা পর্যন্ত কলেজের গেটই পেরোতে না পেরে উত্তেজিত এক প্রৌঢ়। জানালেন, তালিকায় নাম উঠেছে ছেলের। সকাল ১১টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন। ফের ঢোকার চেষ্টা করতেই এক ছাত্রনেতা গেট আটকে বলেন, ‘‘বললাম তো, হবে না। ৯০ হাজারই লাগবে।’’ প্রৌঢ় বলেন, ‘‘আমি সরকারি কর্মী। প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলব। তোমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াতে পারি।’’ উত্তর এল, ‘‘এই কলেজ কে চালায়, জানেন? কিচ্ছু করতে পারবেন না। নিন, আমার ছবি তুলে নিয়ে যান। যান না, পুলিশকে গিয়ে বলুন।’’ পরে অন্য একটি কলেজে ছেলেকে ভর্তি করান ওই প্রৌঢ়। সহ-অধ্যক্ষ অপূর্ব রায়কে ঘটনাটি জানাতে তিনি বলেন, ‘‘গেটের বাইরে পুলিশ আছে। এটা পুলিশের দেখার কথা।’’

বিষয়টি কি জানেন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়? তিনি বলছেন, ‘‘এখনও সে ভাবে কোনও অভিযোগ পাইনি। কোথাও দুর্নীতি হলে আমায় সরাসরি জানাতে পারেন অভিভাবকেরা।’’

কিন্তু বহু ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে সমস্যায় পড়তে হবে ভেবে অনেক পড়ুয়া অভিযোগ করছেন না। সে ক্ষেত্রে কী উপায়? তা অবশ্য জানাননি পার্থবাবু।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন