টাটা গোষ্ঠীর তৈরি গাড়িতে চড়তে নারাজ মুখ্যমন্ত্রী। তাই বিনা টেন্ডারে অন্য সংস্থার তৈরি বুলেটপ্রুফ গাড়ি কিনতে উদ্যোগী হয়েছিল স্বরাষ্ট্র দফতর। কিন্তু অর্থমন্ত্রীর আপত্তিতে বাতিল হয়েছে সেই সিদ্ধান্ত।
নবান্ন সূত্রের খবর, মাস কয়েক আগে ছ’কোটি টাকা খরচ করে দশটি বুলেটপ্রুফ এসইউভি (স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিক্ল) কেনার সিদ্ধান্ত নেয় স্বরাষ্ট্র দফতর। মুখ্যমন্ত্রী-সহ জেড-প্লাস নিরাপত্তাধারী সমস্ত ভিআইপি’র কথা মাথায় রেখেই এতগুলি গাড়ি কেনা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা। কিন্তু গোল বাধে টেন্ডার ডাকা নিয়ে। ভারতে টাটা মোটরস ছাড়া আর একটিমাত্র সংস্থা বুলেটপ্রুফ এসইউভি বানায়। মুখ্যমন্ত্রী যে হেতু টাটার গাড়ি চড়েন না, সে হেতু বিনা টেন্ডারে ওই সংস্থাকে বরাত দেওয়া ছাড়া আর উপায় দেখেননি স্বরাষ্ট্র দফতরের কর্তারা। কারণ, টেন্ডারে যদি টাটারা সর্বনিম্ন দর দেয়, তা হলে তাদের বরাত দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।
কিন্তু স্বরাষ্ট্র দফতরের (যে দফতরের মাথায় মুখ্যমন্ত্রী নিজেই) উদ্যোগ ধাক্কা খায় অর্থ দফতরে। বিনা টেন্ডারে কেন গাড়ি কেনা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অর্থ দফতরের কর্তারা। খোদ অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র স্বরাষ্ট্র-কর্তাদের ডেকে সেই আপত্তির কথা জানিয়েও দেন। তার পরেও নির্দিষ্ট ওই সংস্থা থেকেই গাড়ি কেনার ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হতে থাকে অর্থ দফতরের উপর। প্রায় মাস দু’য়েক টালবাহানার পরে স্বরাষ্ট্র দফতরের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, বিনা টেন্ডারে এত বিপুল টাকার জিনিস কেনা সরকারি নিয়মনীতির পরিপন্থী। অতএব বুলেটপ্রুফ গাড়ি কিনতে হলে দরপত্র চেয়েই কেনা হোক। অর্থমন্ত্রীর আপত্তিতে শেষ পর্যন্ত ই-টেন্ডারের মারফত গাড়ি কেনার জন্য রাজ্যের নিরাপত্তা অধিকর্তাকে নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়।
টাটা সংস্থার পণ্য ব্যবহারে মমতার ‘ছুৎমার্গ’ কোনও নতুন খবর নয়। তাঁর সঙ্গে টাটাদের তিক্ততার সূচনা সিঙ্গুর পর্বে। তা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, কলকাতার রাস্তায় টাটার সংস্থার তৈরি নুন ফেলে বিক্ষোভ দেখিয়েছিল তৃণমূল। দলনেত্রীর মন পেতে সিঙ্গুর আন্দোলনের মঞ্চ থেকে নিজের হাতে থাকা টাটার সংস্থার তৈরি ঘড়ি ছুড়ে ফেলে দিতেও দ্বিধা করেননি তৃণমূল বিধায়ক শীতল সর্দার!
তৃণমূলের জঙ্গি আন্দোলনের জেরে টাটার ন্যানো প্রকল্পকে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাততাড়ি গুটোতে হয়। কিন্তু তার পরেও টাটার বিরুদ্ধে তৃণমূলের অলিখিত ‘বয়কট নীতি’তে ছেদ পড়েনি। শাসকদলের এক নেতা জানান, মমতা এখনও আলিপুরে টাটা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন পাঁচতারা হোটেলটি এড়িয়ে চলেন। কলকাতায় মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহৃত ছোট গাড়ি হোক কিংবা জেলা সফরের এসইউভি— টাটার নাম কোথাও নেই। এমনকী, টাটার গাড়ি চড়তে দলের নেতা-মন্ত্রীদেরও তিনি বারণ করে দিয়েছেন।
বস্তুত টাটার গাড়ি চড়ার জন্য দু’-এক জন তৃণমূল নেতা দলনেত্রীর তিরস্কারের মুখেও পড়েছেন। একদা টাটার এসইউভি’তে সওয়ার হতে অভ্যস্ত ছিলেন যে তৃণমূল সাংসদ, সেই সৌগত রায় জানিয়েছেন, বছর পাঁচেক হল তিনি টাটার গাড়ি চড়েন না। আবার সিঙ্গুরে অশান্তি চলাকালীন বিধানসভার শিল্প বিষয়ক স্থায়ী কমিটির তরফে টাটার একটি কারখানা ঘুরে এসে ‘ইতিবাচক’ রিপোর্ট দিয়েছিলেন তৎকালীন যে কংগ্রেস বিধায়ক, সেই সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় পরে তৃণমূলে যাওয়া ইস্তক প্রকাশ্যে আর টাটার প্রশস্তি করেননি! মমতার সরকার রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পরে গুজরাতের সানন্দে টাটার গাড়ি কারখানা দেখতে যেতে চেয়েছিল বিধানসভার শিল্প বিষয়ক স্থায়ী কমিটি। শাসকদলের শীর্ষ নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে অচিরে পরিকল্পনার সমাধি ঘটে।
ফলে বিনা টেন্ডারে অন্য সংস্থার গাড়ি কিনতে চাওয়ার পিছনে অপ্রত্যাশিত কিছু দেখছেন না তৃণমূল নেতাদের অনেকে। এক জনের কথায়, ‘‘নিরাপত্তার খাতিরেও যে টাটার বুলেটপ্রুফ গাড়ি মমতার সরকার কিনবে না, তা বলাই বাহুল্য।’’
স্বরাষ্ট্র দফতরের একাংশ অবশ্য তাঁদের উদ্যোগের অন্য ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। এক কর্তার যুক্তি: টেন্ডার মারফৎ কিছু কিনতে গেলে অন্তত তিনটি সংস্থার অংশগ্রহণ আবশ্যক। অথচ দেশের মাত্র দু’টো সংস্থা বুলেটপ্রুফ এসইউভি বানায়। তার মধ্যে টাটার গাড়ি এক বার বিগড়ে গেলে সারাতে দু’বছর লেগে যায় বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘‘এই কারণে টেন্ডার ছাড়াই অন্য সংস্থাটিকে গাড়ি সরবরাহের বরাত দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। বুলেটপ্রুফ গাড়ি তৈরিতে ওদের বিশেষ দক্ষতাও রয়েছে।’’ পাশাপাশি নিরাপত্তা আধিকারিকদের কারও কারও যুক্তি, রাজ্যের মন্ত্রী-আমলারা ওই নির্দিষ্ট সংস্থার এসইউভি’তে চড়েন। মু্খ্যমন্ত্রীর কনভয়ে থাকা নিরাপত্তাকর্মীদের অধিকাংশ এসইউভি-ও তাদের তৈরি। ফলে কনভয়ে মুখ্যমন্ত্রীর জন্য অন্য সংস্থার (টাটার) গাড়ি থাকলে তা সহজেই চিহ্নিত করা যাবে, যা নিরাপত্তার পক্ষে খুবই বিপজ্জনক। ঝুঁকি এড়াতে তাই দ্বিতীয় সংস্থাটির তৈরি গাড়ি কেনাই একমাত্র বিকল্প বলে ওঁদের দাবি।
অর্থ দফতরের কর্তারা যদিও এ সব যুক্তি মানতে নারাজ। ওঁদের বক্তব্য, সরকারি ক্রয়-নীতি অনুযায়ী টেন্ডারের ভিত্তিতে গাড়ি কেনার কথা। সেই বিধির উল্লেখ করেই অর্থমন্ত্রীর কাছে ফাইল পাঠানো হয়। দীর্ঘদিন সেটি অর্থমন্ত্রীর কাছে পড়ে ছিল। অমিতবাবুকে টেলিফোনে ধরার চেষ্টা করেও ধরা যায়নি। এসএমএস করা হলে কোনও জবাব আসেনি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলের ইঙ্গিত, দরপত্র ছাড়া গাড়ি খরিদের অনুমতি দিতে অর্থমন্ত্রী যথেষ্ট দোটানায় ছিলেন। শেষমেশ টেন্ডারের মাধ্যমেই গাড়ি কেনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের নিরাপত্তা-অধিকর্তা বীরেন্দ্রও কোনও মন্তব্য করতে চাননি। তিনি শুধু বলেন, ‘‘এটা বাইরে আলোচনার বিষয় নয়।’’
মুখ্যমন্ত্রী-সহ ভিআইপিদের সুরক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত স্পেশ্যাল সিকিওরিটি উইংয়ের (এসএসডব্লিউ) তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের হাতে আপাতত ১৯টি বুলেটপ্রুফ অ্যাম্বাসাডর গাড়ি রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে ১১টি বুলেটপ্রুফ এসইউভি, যার তিনটে টাটার তৈরি। জেলা সফরে গেলে মুখ্যমন্ত্রী বুলেটপ্রুফ এসইউভি’তেই চড়েন, তবে টাটার তিনটি বাদ দিয়ে।
তা হলেও তো ২৭টি বুলেটপ্রুফ গাড়ি হাতে থাকছে। আবার দশটার দরকার পড়ল কেন?
এসএসডব্লিউয়ের এক কর্তার ব্যাখ্যা: মুখ্যমন্ত্রীকে বাদ দিলেও জেড-প্লাস ক্যাটেগরির বিভিন্ন ভিআইপি নিত্য রাজ্যে আসেন। ওঁদের বুলেটপ্রুফ গাড়ি লাগে। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জন্য দু’টি গাড়ি বরাদ্দ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কলকাতা এলে পাঁচটি গাড়ি দিতে হয়। রাষ্ট্রপতির প্রতি অনুষ্ঠানে দু’টো গাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক। এ দিকে অ্যাম্বাসাডরগুলোর বেশির ভাগ পুরনো হয়ে গিয়েছে। উপরন্তু তাদের নির্মাতা হিন্দুস্থান মোটরসের কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মেরামতি করা সমস্যা। তাই ধাপে ধাপে অ্যাম্বাসাডর তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ‘অন্য রাজ্য তো এখন এসইউভি-ই কিনছে।’’— বলছেন এক সুরক্ষা-আধিকারিক।