একা সুফিয়ানে নেই রক্ষা, ট্র্যাডিশন চলছেই

বাম জমানার শেষ দিকে অনেকের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল ছবিটা! জঙ্গলমহলে তখন এক দিকে মাওবাদী হানায় রক্তপাত আর অন্য দিকে তার মোকাবিলায় সিপিএমের ‘জঙ্গি নীতি’র বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন বাড়ছে। নেতাই-কাণ্ডের পরে লালগড়ের রুখা প্রান্তরে হঠাৎই জনতার হাতে আক্রান্ত হয়েছিল প্রাসাদোপম এক অট্টালিকা! সে বাড়ির মালিক ছিলেন সিপিএমের স্থানীয় নেতা ডালিম পাণ্ডে, অনুজ পাণ্ডেরা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:০১
Share:

শেখ সুফিয়ান

বাম জমানার শেষ দিকে অনেকের চোখ কপালে তুলে দিয়েছিল ছবিটা! জঙ্গলমহলে তখন এক দিকে মাওবাদী হানায় রক্তপাত আর অন্য দিকে তার মোকাবিলায় সিপিএমের ‘জঙ্গি নীতি’র বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন বাড়ছে। নেতাই-কাণ্ডের পরে লালগড়ের রুখা প্রান্তরে হঠাৎই জনতার হাতে আক্রান্ত হয়েছিল প্রাসাদোপম এক অট্টালিকা! সে বাড়ির মালিক ছিলেন সিপিএমের স্থানীয় নেতা ডালিম পাণ্ডে, অনুজ পাণ্ডেরা। একে লালগড়ের মতো এলাকা, তায় নেতারা কমিউনিস্ট পার্টির! বৈভবের প্রমাণ হাতের সামনে পেয়ে সে দিন আছড়ে পড়েছিল জনরোষ। যার মধ্যে মিশে ছিল তৃণমূলের বিক্ষোভও।

Advertisement

এখনও জনরোষের পর্যায়ে গিয়ে না পৌঁছলেও ক্ষমতার মধুভাণ্ডের স্পষ্ট ছাপ দেখতে পাচ্ছেন তৃণমূল নেতৃত্বও। মাত্র সাড়ে চার বছরেই! সিপিএমের মতো ‘হোলটাইমারে’র চল অবশ্য তৃণমূল বা কংগ্রেসের মতো দলে বিশেষ থাকে না। তবু সামান্য উপার্জনে দিন চালানো নেতারা পাড়ায় পা়ড়ায় বা জেলায় জেলায় যে ভাবে কয়েক বছরেই রীতিমতো সাম্রাজ্য হাঁকিয়ে ফেলেছেন, তা চিন্তার ভাঁজ ফেলছে শাসক দলের নেতাদের কপালে। ঘটনাচক্রে, নন্দীগ্রামে গিয়ে সোমবার দলের নেতা শেখ সুফিয়ানের পাঁচ মহলা বাড়ি দেখে যারপরনাই ক্ষিপ্ত হয়েছেন স্বয়ং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! রাগত মেজাজেই দলনেত্রীর ইচ্ছা, বড় বাড়ি বেচে দিয়ে আবার সাধারণ জীবনযাপনে ফিরে যান সুফিয়ান। তৃণমূল নেত্রীর এই ভর্ৎসনাকে ভোটের আগে ভাবমূর্তি উদ্ধারের চেষ্টা হিসাবেই দেখা হচ্ছে। এবং দলের অন্দরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতারাই মেনে নিচ্ছেন, সুফিয়ান নেহাত ঘটনাচক্রে সামনে এসে পড়েছেন! অন্যথায় শাসক দলে তো কম্বলের লোম বাছার জোগাড়!

তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য, বাড়ির জন্যই কয়েক বছর আগে আরও এক বার দলনেত্রীর ধমকের মুখে পড়েছিলেন সুফিয়ান! ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে নন্দীগ্রাম থেকে জিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ হয়েছিলেন তিনি। আর মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার বছরখানেকের মধ্যে ২০১২ সালের ১৪ মার্চ মমতা নন্দীগ্রাম পৌঁছে সরাসরি গিয়েছিলেন তাঁরই বাড়িতে। সেই সময় সুফিয়ানের বাড়ি ছিল ভাঙাচোরা। সামনে ছিল মজা পুকুর। মুখ্যমন্ত্রী সে বার সুফিয়ানকে ধমকেছিলেন পুকুর পরিষ্কার করানোর জন্য! আর এ বার গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী চমকে গিয়েছেন সুফিয়ানের পাঁচ তলা বাড়ি দেখে! যার নাম হয়েছে ‘মাশাল্লাহ’! দু’বছর আগের পঞ্চায়েত নির্বাচনে ফের জিতে সুফিয়ান জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতির পদ পাওয়ার পরে যে অট্টালিকা মাথা তুলেছে ওই একই জায়গায়! এবং যা দেখে দলনেত্রীর প্রতিক্রিয়াও গিয়েছে পাল্টে!

Advertisement

বস্তুত, ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেত্রী সুফিয়ানের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন তমলুকের সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে। যদিও দলীয় সূত্রের খবর, পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব এখনই কোনও কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষপাতী নন। দলের এক জেলা নেতার বক্তব্য, ‘‘ভোটের আর দেরি নেই। নন্দীগ্রাম থেকে শুভেন্দু লড়বেন বলে দলনেত্রী ঘোষণাও করে দিয়েছেন। এই অবস্থায় সুফিয়ানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা আছে!’’

ভোটের আগে দলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি তুলে ধরতে দলীয় বৈঠকে এখন নেতা-কর্মীদের বারবার বার্তা দিচ্ছেন মমতা। সুফিয়ানের অট্টালিকা নিয়ে ক্ষোভ সেই বার্তারই অঙ্গ বলে তৃণমূলের রাজ্য নেতাদের মত। একই সঙ্গে রাজ্য তৃণমূলের এক শীর্ষ নেতা ঈষৎ রসিকতার ঢঙে বলছেন, ‘‘সুফিয়ানের বাড়ি চোখে পড়েছে। কিন্তু এ রকম অনেকেই আছে আমাদের দলে! ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে!’’ আবার দলের এক প্রথম সারির নেতা মনে করেন, ‘‘দলনেত্রী প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে ভালই করেছেন। দলের যারা দ্রুত টাকা রোজগার করে বিলাসবহুল জীবনের দিকে ছুটছে, তারা যদি এতে একটু সমঝে যায়! দলনেত্রী নিজে তো এখনও অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাপন করেন। তিনি আশা করেন, দলের লোকেরাও সেই রকমই করবে।’’ যদিও দলের মধ্যেই একাংশের পাল্টা প্রশ্ন, দলনেত্রীর জীবনযাপন দেখে নেতা-কর্মীরা ‘অনুপ্রানিত’ হলে তো আর নন্দীগ্রামে গিয়ে সুফিয়ানকে তিরস্কারের দরকারই পড়ত না!

তথ্য বলছে, তাঁরাচাঁদবাড় গ্রামের এই বাসিন্দা ১৯৯৮ সালে সিপিএমের হয়ে নন্দীগ্রাম পঞ্চায়ত সমিতির সভাপতি হন। কিন্তু আড়াই বছরের মাথায় তাঁকে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এক সময় কাপড়ের দোকান ও গরু ব্যবসা, পরে কাঠের ব্যবসাও ছিল। পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি থাকাকালীন টালির চাল বদলে একতলা পাকা বাড়ি করেছিলেন! সিপিএম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে ২০০৩-এ পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলে যোগ। সে বার অবশ্য হেরেছিলেন। নন্দীগ্রাম বিধানসভায় ২০০৬-এ সিপিআইয়ের ইলিয়াস মহম্মদের কাছেও হার। তার পরে নন্দীগ্রামে ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’ থেকেই চাকা ঘোরার শুরু।

যে যাত্রার কাহিনি দেখে তৃণমূলেরই এক প্রবীণ নেতার উক্তি, ‘‘ওই জেলায় লক্ষ্মণ শেঠ পেল্লায় সম্পত্তি বাগিয়েছিলেন! আমাদেরও না হয় সুফিয়ান হল!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন