ফিরে এসো মেঘ, আকুতি অন্তর্জালে

কালিদাসের কালে মেঘ ছিল অঢেল। নির্বাসিত যক্ষ অনায়াসেই মেঘকে দূত করে পাঠাতে পেরেছিল প্রিয়ার কাছে।চেরাপুঞ্জির থেকে গোবি-সাহারার বুকে একখানা মেঘ ধার দেওয়া যায় কি না, ব্যাকুল প্রশ্ন করেছিলেন রবীন্দ্রযুগের অন্য সুরের কবি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৬ ০৫:৫১
Share:

কালিদাসের কালে মেঘ ছিল অঢেল। নির্বাসিত যক্ষ অনায়াসেই মেঘকে দূত করে পাঠাতে পেরেছিল প্রিয়ার কাছে।

Advertisement

চেরাপুঞ্জির থেকে গোবি-সাহারার বুকে একখানা মেঘ ধার দেওয়া যায় কি না, ব্যাকুল প্রশ্ন করেছিলেন রবীন্দ্রযুগের অন্য সুরের কবি।

আর এ যুগের ফেসবুক এবং হোয়াটসঅ্যাপে যে-বার্তাটি আপাতত ক্রমে রটি যাচ্ছে, সেটি আসলে এক জনের নিরুদ্দিষ্ট হওয়ার খবর! একই সঙ্গে তাকে ফিরে পাওয়ার আর্তি। যার খোঁজ মিলছে না, রং তার বেজায় কালো, চেহারা ভারিক্কি গোছের। খোঁজ পেলে কোথায় জানাতে হবে, তা-ও বলে দেওয়া আছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়া বার্তায়। ঘনঘন ‘শেয়ার’ হতে হতে ভোট-বাজারেও শহর-গ্রাম-গঞ্জের দখল নিয়েছে এই নিখোঁজ-সংবাদ।

Advertisement

নিখোঁজ হয়েছে মেঘ। গত প্রায় এক মাস ধরে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের আকাশে গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ মেঘের দেখা নেই! তাকেই খুঁজছে ব্যাকুল বাংলা।

খুঁজছে। কেননা এপ্রিলের গোড়া থেকে যে-গরমাসুর ধিকিধিকি তুষানলে দগ্ধে চলেছে, তার অত্যাচার থেকে রেহাই পাওয়ার মোক্ষম অস্ত্র আছে মেঘের হাতেই। সেই অস্ত্রের নাম ঝড়বৃষ্টি। কিন্তু খালি চোখে তো নয়ই, রেডা়র-চিত্র ঢুঁড়েও কালো, ভারী চেহারার মেঘের দেখা পাচ্ছেন না আবহবিদেরা। তাই স্বস্তির আশ্বাস দূরের কথা, নিজেরাও ক্রমশ উদ্যম হারিয়ে ফেলছেন তাঁরা। রবিবার সেই হতাশার সুরই শোনা গেল কেন্দ্রীয় আবহাওয়া মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল গোকুলচন্দ্র দেবনাথের গলায়। বললেন, ‘‘বৃষ্টির কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তাই কোনও সুখবরও আমাদের কাছে নেই।’’

গোকুলবাবুরা কতটা হতাশ, তার ইঙ্গিত মিলল হাওয়া অফিসের অন্দরে। সেখানকার খবর, কোথাও কোথাও স্থানীয় ভাবে বৃষ্টির হাল্কা সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু খামখেয়ালি প্রকৃতির কথা ভেবে আবহবিজ্ঞানীরা সে-কথা ঘোষণা করতে চাইছে না। আসলে গত মরসুম থেকে ঋতুতে ঋতুতে আবহাওয়ার রথ উল্টো পথে চালিয়ে প্রকৃতি এমনই তুঘলকিপনা করে চলেছে যে, তার মেজাজমর্জির আভাস পেলেও তা জানানোর ঝুঁকি নিতে চাইছে না হাওয়া অফিস।

কিন্তু মেঘ কোথায় লুকোল যে, সোশ্যাল মিডিয়ার হারানো-প্রাপ্তি-নিরুদ্দেশ স্তম্ভে বিজ্ঞাপন দিতে হচ্ছে?

আসলে হাল্কা-পলকা অকাজের মেঘ আছে। যার খোঁজ চলছে, সে জলভরা মেঘ। তার দাক্ষিণ্য পেতে হলে প্রথমে চাই জলীয় বাষ্প। পর্যাপ্ত পরিমাণে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, জলীয় বাষ্প ঢুকছে বটে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। এবং গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের আকাশে তা আদৌ থিতু হতে পারছে না। অথচ জলীয় বাষ্প থেকে ঝড়বৃষ্টির মেঘ তৈরি হতে গেলে তাকে থিতু হতেই হবে। আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানীদের অনেকে জানাচ্ছেন, দিন দুয়েক ধরে রাতের দিকে সামান্য জলীয় বাষ্প ঢুকছে। তার ফলে তৈরি হচ্ছে হাল্কা হাল্কা মেঘ। ভোরের দিকে আকাশে হাল্কা মেঘের আবরণ থাকায় তাপমাত্রা সামান্য কমেও যাচ্ছে।

সেই সব মেঘ যাচ্ছে কোথায়?

আবহবিদদের একাংশের ব্যাখ্যা, ওই ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ ঝাড়খণ্ড থেকে বয়ে আসা শুকনো গরম হাওয়ার সঙ্গে কোনও ভাবেই এঁটে উঠতে পারছে না। তাই বেলা বাড়লেই শুরু হচ্ছে জ্বলুনি। সেই সঙ্গে বৈশাখেও ত্বকে মালুম হচ্ছে পৌষের টান। এই শুকনো হাওয়ার জন্য গত দু’দিনে পারদের পতনও সে-ভাবে বুঝতে পারেননি মানুষজন। শনি ও রবিবার কলকাতা বা সংলগ্ন এলাকায় তাপপ্রবাহ হয়নি। রবিবার মহানগরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৮.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, স্বাভাবিকের থেকে তিন ডিগ্রি বেশি। বীরভূমে এ দিন ভোট-রাজনীতির উত্তাপ চরমে উঠলেও প্রকৃতি তার তেজ খানিকটা সংবরণ করেছে বলেই খবর। শ্রীনিকেতনে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা (৩৭.৩ ডিগ্রি) স্বাভাবিক ছিল। তবে বাঁকুড়ায় এ দিনও তাপপ্রবাহ বয়েছে। বর্ধমানে পারদ ছুঁয়েছে ৪০ ডিগ্রির কোঠা।

রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আর পশ্চিম মেদিনীপুরের একাংশে শুকনো গরম অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু কলকাতা-সহ গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গের খাসতালুকে বৈশাখে গরমে ঘেমেনেয়ে যাওয়াটাই পরিচিত চিত্র। এ বার সেই চেনা ছবি বদলে গিয়েছে। দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে জাঁকিয়ে বসেছে শুকনো গরম। বইছে ‘লু’ বা গরম হাওয়া। এর জন্য বঙ্গোপসাগরে উচ্চচাপ বলয়ের অনুপস্থিতিকেই দায়ী করছেন আবহবিজ্ঞানীদের অনেকে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের খবর, বাংলা উপকূলে থাকা উচ্চচাপ বলয়ই সাগর থেকে জোলো হাওয়া এনে দেয় দক্ষিণবঙ্গে। তার জেরেই বাতাসে আর্দ্রতা বাড়ে। ঘাম হলেও তাপমাত্রায় রাশ টানে সেই আর্দ্রতা। ঠেকিয়ে রাখে শুকনো গরম হাওয়ার আগ্রাসনকেও। কিন্তু এ বার বায়ুমণ্ডলে চাপের তারতম্যের ফলে উচ্চচাপ বলয় বাংলা উপকূল থেকে সরে গিয়েছে। পরিণামে ঝাড়খণ্ড থেকে হুহু করে শুকনো হাওয়া ঢুকছে গাঙ্গেয় বঙ্গে।

গাঙ্গেয় বাংলার কাছে এই গরম রীতিমতো অচেনা ও অবাঞ্ছিত আগন্তুক। আবহাওয়া দফতরের অনেক প্রবীণ বিজ্ঞানীও জানাচ্ছেন, দীর্ঘ কর্মজীবনে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে গরমের এমন চেহারা দেখেননি তাঁরা। মাঝেমধ্যে লু বা তাপপ্রবাহ যে বইত না, তা নয়। কিন্তু সেই সব তাপপ্রবাহকে স্থায়ী হতে দেখা যেত না। সেই নিরিখে এ বারের গরমকে বিরল বলছেন আবহবিদেরা।

‘‘বঙ্গোপসাগরের উচ্চচাপ বলয়ের এমন দশার কারণ কী, তা নিয়েও গবেষণা প্রয়োজন,’’ মন্তব্য হাওয়া অফিসের এক প্রবীণ বিজ্ঞানীর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন