বেখাপ্পা বহুতল পছন্দ করতেন না কোরিয়া

কংক্রিট নগরীর বুকের দারুণ মর্মব্যথা বুঝতে ভুল হয়নি তাঁর। সমকালীন স্থাপত্যের যশস্বী ব্যক্তিত্ব চার্লস কোরিয়া বিশ্বাস করতেন, আধুনিক জীবনের যাবতীয় চাহিদা মেনেও পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার শর্তটুকু কখনওই অগ্রাহ্য করতে নেই।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০৩:৪৮
Share:

চার্লস কোরিয়া

কংক্রিট নগরীর বুকের দারুণ মর্মব্যথা বুঝতে ভুল হয়নি তাঁর।

Advertisement

সমকালীন স্থাপত্যের যশস্বী ব্যক্তিত্ব চার্লস কোরিয়া বিশ্বাস করতেন, আধুনিক জীবনের যাবতীয় চাহিদা মেনেও পরিবেশ ও স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার শর্তটুকু কখনওই অগ্রাহ্য করতে নেই।

জীবনভর নতুন নগরসৌধ গড়ার কাজ ও নগর পরিকল্পনায় ব্রতী এই স্থাপত্যবিদ মঙ্গলবার রাতে মারা গেলেন মুম্বইয়ে। বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর। জন্ম সেকেন্দরাবাদে হলেও কৈশোর ও শিক্ষাজীবন মুম্বইয়েই কেটেছিল চার্লসের। এর পরে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় ও এমআইটি-তে উচ্চশিক্ষার জন্য যান তিনি। ফিরে এসে আবার মুম্বইয়েই থিতু হন। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, কিছু দিন ধরে বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন চার্লস। ফেসবুকে তাঁর পরিবারের তরফে একটি বার্তায় বলা হয়েছে, আজ, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় দাদারের পর্তুগিজ গির্জায় চার্লসের অন্ত্যেষ্টি অনুষ্ঠান সম্পন্ন হবে। এর পরে ওরলির হাইন্‌স রোড সেমেট্রিতে প্রয়াত স্থাপত্যবিদকে সমাহিত করার কথা। চার্লসের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটারে শোক জানিয়ে বলেছেন, চার্লসের সৃষ্ট স্থাপত্য নিদর্শনগুলিতে অনবদ্য নান্দনিক বোধের প্রকাশ ঘটেছে।

Advertisement

বাস্তবিক চার্লসের ছোঁয়া পেয়ে দেশ-বিদেশের শহরে ‘স্কাইলাইন’ যেন অন্য মাত্রা পেয়েছিল। আমদাবাদের সাবরমতী আশ্রমে মহাত্মা গাঁধীর স্মৃতি মিউজিয়ম, মুম্বইয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা আবাসন টাওয়ার বা জয়পুরের জওহর কলাকেন্দ্র থেকে শুরু করে লিসবন, বস্টন বা টরন্টো শহরের স্থাপত্য নিদর্শনেও চার্লসের সংবেদী অনুভব জড়িয়ে আছে। একেলে নাগরিক স্থাপত্য মানে যে শুধু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের কৃৎকৌশল নয়, সারা জীবনের কাজে সেটাই বুঝিয়ে গিয়েছেন চার্লস। আমদাবাদে স্বল্প আয়ের নাগরিকদের জন্য ‘টিউব হাউস’ গড়ার সময়ে তিনি বলেছিলেন, ‘মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারের ভাবনার ধাঁচে আমার কল্পনাশক্তি শুকিয়ে যায়।’ শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের উপরে নির্ভরতায় তত বিশ্বাসী ছিলেন না চার্লস। আমদাবাদের ওই আবাসনই হোক বা মুম্বইয়ের ৩২ তলা বাড়ি, আলো-হাওয়া খেলানোর দিকটায় কখনও আপস করেননি তিনি। ২০০৪ সালে সল্টলেকের সিটিসেন্টার গড়তে এ শহরে এসেছিলেন। খানিকটা ছাদের নীচে, খানিকটা আকাশের ছায়ায়, কিছুটা ছাড়া-ছাড়া সৌধের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন চার্লস। দু’দশক আগে খানিকটা একই ধাঁচে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সঞ্জয় সেনের বাড়িটিও তাঁর পরিকল্পনায় গড়ে ওঠে।


চার্লস কোরিয়ার পরিকল্পনায় তৈরি বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে সঞ্জয় সেনের বাড়ি। — নিজস্ব চিত্র।

কারও কারও মতে এ হল, ‘ওপেন-টু-স্কাই’ স্থাপত্যশৈলী। কেউ কেউ চার্লসের কাজে কিউবিজমের প্রভাব খুঁজে পান। টুকরো-টুকরো উপাদান নিয়ে তাঁর স্থাপত্য ভাবনাকে জ্যান্ত করে তুলতে ভালবাসতেন চার্লস। একাধিক উঠোন, চাতাল, ছাদের ছড়াছড়ি তাঁর কাজে। তবে ভারতের পটভূমিতে বেখাপ্পা বা মাটির সঙ্গে যোগবিহীন কিছু গড়ে তোলা না-পসন্দ ছিল তাঁর। বিশেষ করে এ দেশের শহরে ম্যানহাটনের ‘গ্লাস টাওয়ার’-এর নকলে একেলে স্থাপত্য যেন চার্লসের দু’চোখের বিষ। তিনি বলতেন, ‘কাচ নিয়ে কাজ করতেই পারি, করেওছি। কিন্তু ‘গ্লাস টাওয়ার’ গড়তে যাব না।’ তবে টরন্টোয় ইসলামিক চর্চা কেন্দ্র গড়ে তুলতে গিয়ে ক্রিস্টাল পাথরের ব্যবহার করেছিলেন। এ বছর অন্টারিওর স্থাপত্যবিদদের তরফে উৎকর্ষ পুরস্কারও পায় এই কাজ। বস্টনে বিশ্বের সব থেকে বড় স্নায়ুবিজ্ঞান কেন্দ্রও (এমআইটি-র ব্রেন অ্যান্ড কগনিটিভ সায়েন্সেস সেন্টার) চার্লসের সৃষ্টি। লিসবনে অতলান্তিক মহাসাগর ও টেজু নদীর কিনারে একটি চোখজুড়োন গবেষণা ও স্বাস্থ্যপরিষেবা কেন্দ্রও তিনি গড়ে তোলেন। সেখানেও কনফারেন্স, গবেষণাকেন্দ্র ও অ্যাম্ফিথিয়েটারের সুষম বিন্যাস।

পৃথিবী জুড়ে কাজ করে বেড়ালেও চার্লসের মনটা কিন্তু নিজের দেশে পড়ে থাকত। এমআইটি-তে স্নাতকোত্তর পড়ার সময়ে চার্লসকে শিক্ষক হিসেবে কাছে পেয়েছিলেন কলকাতার স্থাপত্যবিদ অয়ন সেন। চার্লস তখন আমেরিকায় পড়ানোর ফাঁকে-ফাঁকে কলকাতার সিটি সেন্টারের কাজটা নিয়েও মশগুল। অয়ন বলছিলেন, ওয়াশিংটনে অ্যানাকোস্টিয়া নদীর পাড়ে এমআইটি-র প্রকল্পে উনি উপদেষ্টা ছিলেন। ‘‘চার্লস বারবার বলতেন, কলকাতার অমন সুন্দর নদীর পাড়টাকে নিয়ে যদি মনের মতো কিছু করা যেত। আমাদের বারবার দেশে ফিরে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন।’’

তবু দেশের মাটিতে সব সময় মনের মতো কাজ করার সুযোগ পাননি চার্লস। এই নিয়ে তাঁর ভিতরে ক্ষোভ জমে ছিল। ’৭০-এর দশকে ‘নবি মুম্বই’ গড়ার কাজ করলেও গোটা শহরটা, তাঁর নিজের পাড়াটা মনের মতো করে গড়ে তুলতে না-পারার আক্ষেপ থেকে গিয়েছিল। মুম্বইয়ে তিন দশক আগে ‘আর্বান ডিজাইন রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠা করলেও আমলাতান্ত্রিক ফাঁস বারবার তাঁর পা টেনে ধরেছে। গত বছরও একটি আলোচনাসভায় এ নিয়ে আফশোসের কথা বলেছিলেন তিনি। তাঁর বই ‘আ প্লেস ইন দ্য শেড’-এ মুম্বই প্রসঙ্গে চার্লস লেখেন, ‘শহরটা দিন-দিন যতই উন্নত হোক, পরিবেশটা ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। এ যেন ধ্বংসের আগে শেষ শক্তির দাপাদাপি!’

দেশের ‘পদ্মবিভূষণ’ সম্মান বা জাপান, ব্রিটেনের গুণিজনের বিচারে ভারতের সেরা স্থাপত্যবিদের স্বীকৃতি চার্লসের এ যন্ত্রণা দূর করতে পারেনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন