যুদ্ধের কথায় আঁতকে উঠছে সেনাদের বাড়ি

তিনি কৃষ্ণনগরের কালীনগরের বাসিন্দা, বছর পঁচাত্তরের জীবেন্দ্রলাল সরকার। ১৯৮৬ সালে সেনা থেকে অবসর নিয়েছেন। নিজে লড়েছেন ১৯৬৫ আর ১৯৭১ সালের যুদ্ধে, এই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই। শরীর জুড়ে বার্ধক্য। চোখের দৃষ্টি কমে এসেছে। কিন্তু মেরুদণ্ড এখনও ঋজু। একমাত্র ছেলে সাগর অরুণাচল প্রদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত। 

Advertisement

সুস্মিত হালদার

কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৯ ০০:৩৫
Share:

—প্রতীকী ছবি।

তিনি নিজে দু’বার যুদ্ধে গিয়েছেন। নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছেন, যুদ্ধ কখনও সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। বুঝেছেন, যুদ্ধ শুধু মানুষের জীবন কাড়ে না, দেশের অভ্যন্তরে ডেকে আনে গভীর বিপর্যয়, যা সামাল দিতে লেগে যায় বছরের পর বছর।

Advertisement

তাই যুদ্ধের সম্ভাবনা শুনেই তিনি বলে ওঠেন, “না না, আমরা যুদ্ধ চাই না! যুদ্ধ করে কিছু হয় না। আর এটা তো যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা। কোল খালি হবে আমাদের, লাভ হবে অন্য কারও।”

তিনি কৃষ্ণনগরের কালীনগরের বাসিন্দা, বছর পঁচাত্তরের জীবেন্দ্রলাল সরকার। ১৯৮৬ সালে সেনা থেকে অবসর নিয়েছেন। নিজে লড়েছেন ১৯৬৫ আর ১৯৭১ সালের যুদ্ধে, এই পাকিস্তানের বিরুদ্ধেই। শরীর জুড়ে বার্ধক্য। চোখের দৃষ্টি কমে এসেছে। কিন্তু মেরুদণ্ড এখনও ঋজু। একমাত্র ছেলে সাগর অরুণাচল প্রদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত।

Advertisement

বাড়িতে ছোট দুই ছেলেমেয়ে। যুদ্ধের কথা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সাগরের স্ত্রী রুমা। কোলে ন’মাসের ছেলে। আঁচলে হাত মুছতে-মুছতে রুমা বলেন, “আমরা আমাদের প্রিয়জনকে হারাতে চাই না। যুদ্ধ চাই না।”

কাশ্মীরে জঙ্গি হানায় জওয়ানদের মৃত্যুর পরে দেশ জুড়ে জাতীয়তাবাদের ঝড়, যুদ্ধের জিগির। সোশ্যাল মিডিয়া যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে পোস্টে ছয়লাপ। কিন্তু যাঁদের পরিবারের লোক সেনায় বা আধা-সেনায় রয়েছে, তাঁদের বুক কাঁপছে। তাঁরা চাইছেন না, বেয়নেট-বন্দুক হাতে তাঁদের প্রিয়জনকে শত্রুর মুখোমুখি হতে হোক। তাঁরা চাইছেন না, তেরঙ্গায় মোড়া কফিনে ফিরুক বীরের মর্যাদা পাওয়া নিথর দেহ।

যুদ্ধের কথা উঠতেই আঁতকে ওঠেন শান্তিপুরের পল্লবী প্রামাণিক। তাঁর স্বামী বাপি প্রামানিক কাশ্মীরে সিআরপি-তে কর্মরত। বলে ওঠেন, “না না, যুদ্ধ চাই না! শুধু কিছু পরিবার নষ্ট হয়। আমরা চাই না, সেটা হোক। কথা বলে সমস্যার সমাধান হোক।” তাঁর আশঙ্কা, “যুদ্ধ যদি হয়, আমার স্বামীকেও যেতে হবে। আমি কি তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে চাইতে পারি?”

দুশ্চিন্তায় মাথা খারাপ পাটাবুকার মহেশ প্রামাণিকের। তাঁর ভাই শান্তিময় প্রামাণিক আর শালা বাপন হালদার আছেন বিএসএফ-এ। বাপন এখন কাশ্মীরে আর শান্তিময় অসমে। যুদ্ধের কথা শুনেই ফুঁসে উঠে মহেশ বলছেন, “যারা যুদ্ধ-যুদ্ধ করে হেদিয়ে মরছে, তাদের আগে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান দেখি! মুখে বলা খুব সহজ। যুদ্ধে কী হয়? শুধু কিছু মানুষ মরে। কোনও স্থায়ী সমাধান? আগেও হয় নি, পরেও হবে না।”

কৃষ্ণনগরের বাগদিপাড়ার মিন্টু মালাকার কাজ করেন এসএসবি-তে, আপাতত উত্তরাখণ্ডে। যুদ্ধের জিগিরে উদ্বিগ্ন তাঁর পরিবারের লোকেরাও। তাঁর দাদা বিনু মালাকার বলছেন, “যুদ্ধ কখনও কারও ভাল করতে পারে না। দু’পক্ষেই মানুষ মরে। দু’দিকেরই ক্ষতি।” তিনি চান, “দুই দেশের নেতারা মুখোমুখি বসুন, কথা বলুন। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করুন।”

নিরন্তর যাঁরা সোশ্যাল মিডিয়ায় যুদ্ধের শিঙে ফুঁকছেন আর সার্জিক্যাল স্ট্রাইক-টু বলে বাদ্যি বাজিয়ে উন্মত্ত নৃত্য করছেন, তাঁদের বোঝাবে কে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন