(বাঁ দিক থেকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সিভি আনন্দ বোস, পিনারাই বিজয়ন। —গ্রাফিক শৌভিক দেবনাথ।
বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তাঁর টানা ২৬ দিনের অনশন এবং ধর্নার কথা গো়টা দুনিয়া জানে। সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর এখনও পর্যন্ত দু’বার ধর্না দিয়েছেন। তাঁর প্রথম ধর্না ছিল ধর্মতলার মোড়ে সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয় ধর্না রেড রোডে। রাজ্যকে কেন্দ্রীয় বঞ্চনার বিরুদ্ধে। মঙ্গলবার শিক্ষক দিবসের অনুষ্ঠানে তৃতীয় বার ধর্নার হুঁশিয়ারি দিয়ে দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। এ বার তাঁর ধর্না বাংলার রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের ভূমিকা নিয়ে।
মমতার ওই ধর্নার হুঁশিয়ারির পর অনেকে বলছেন, কেরলের ‘ভূমিপুত্র’ বোসের বিরুদ্ধে কি মমতা ‘কেরল মডেল’ অনুসরণ করেই চাপ তৈরি করতে চাইছেন?
কেরল মডেল কী?
গত বছর নভেম্বর মাসে কেরলের রাজ্যপাল আরিফ মহম্মদ খানের বিরুদ্ধে রাজভবন ঘেরাওয়ের ডাক দিয়েছিল সেখানকার শাসকদল সিপিএম। দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী বৈঠক করে রাজভবন ঘেরাও করার কর্মসূচি ঘোষণা করে। জানানো হয়, হাজার হাজার মানুষের জমায়েত নিয়ে ঘিরে রাখা হবে রাজ্যপালকে। সেই ধর্নায় থাকবেন কেরলের মুখ্যমন্ত্রী তথা দলের পলিটব্যুরোর সদস্য পিনারাই বিজয়নও। যদিও শেষপর্যন্ত সেই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়নি। মৌখিক হুঁশিয়ারির জায়গাতেই থেকে গিয়েছিল। তবে মুখ্যমন্ত্রী মমতার মঙ্গলবারের হুঁশিয়ারির সঙ্গে সিপিএম তথা বিজয়নের হুঁশিয়ারির একটি তফাত আছে— মমতা নিজেই (প্রয়োজন হলে) রাজভবনের সামনে ধর্নার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আর কেরলের রাজ্যপালের আবাসস্থলের সামনে ধর্নার ডাক দিয়েছিল শাসকদল সিপিএম। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নের সেই ধর্নায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা যে ভাবে প্রয়োজনে রাজভবনের সামনে ধর্না দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়িত হলে সেটি সাম্প্রতিককালে নজিরবিহীন হবে।
মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে মমতা প্রথম ধর্নায় বসেছিলেন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে। ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের লাউডন স্ট্রিটের বাংলোয় হানা দিয়েছিল সিবিআই। তখনই রাজীবের বাংলোয় পৌঁছন মমতা। তার ধর্মতলার মেট্রো চ্যানেলে ধর্নায় বসেন তিনি। ঘটনাচক্রে, বিরোধী নেত্রী থাকাকালীন যেখানে ২৬ দিন অনশন করেছিলেন মমতা। মমতার সেই ধর্না কর্মসূচি চলেছিল ৫ ফেব্রুয়ারি দুপুর পর্যন্ত। রাজীব সুপ্রিম কোর্টে রক্ষাকবচ পাওয়ার পর ধর্না তোলেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা দ্বিতীয়বার ধর্নায় বসেন গত ২৯ এবং ৩০ মার্চ। রেড রোডে আম্বেডকর মূর্তির পাদদেশে সেই ধর্নার মূল বিষয় ছিল ১০০ দিনের কাজের বকেয়া টাকা কেন্দ্রের কাছ থেকে না পাওয়া। পাশাপাশি, অন্যান্য কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে প্রতিবাদের বিষয়ও ছিল।
উচ্চশিক্ষার নানাবিধ বিষয় নিয়ে নবান্ন ও রাজভবনের সংঘাত জারি রয়েছে। ঘটনাচক্রে, কেরলের সিপিএমও উচ্চশিক্ষায় কেরলের রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ‘নাক গলানো’র অভিযোগ তুলেই রাজভবনে ধর্না দেওয়ার কথা বলেছিল। মমতা মঙ্গলবার রাজ্যপালকে লক্ষ্য করে বলেছেন, ‘‘আপনি কেরল থেকে যাঁদের নিয়ে এসে এখানে চা খাওয়ান, সেটাও আমাদের পয়সায়! আমাদের মানে সরকারের। সরকারের মানে রাজ্যের মানুষের।’’ সেইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যপাল তথা আচার্যের কথামতো যদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলে, তা হলে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে তিনি ‘অর্থনৈতিক বাধা’ তৈরি করবেন। মমতার কথায়, ‘‘কোনও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় আপনার কথা শুনে চললে আমি অর্থনৈতিক বাধা তৈরি করব। তার পরে দেখি আপনি কী করে মাইনে দেন! আমি দরকারে রাজভবনের সামনে ধর্না দিতে বাধ্য হব। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে পড়তে দেব না!’’
মুখ্যমন্ত্রীর এই আগ্রাসী মেজাজের পর রাজ্যপাল বোস কী করবেন সেটা যেমন দেখার, সেইসঙ্গে এ-ও দেখার, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধানের বাসভবনের দুয়ারে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ধর্নায় বসলে তার কী অভিঘাত তৈরি হয়।