দর কমতেই উধাও জীবনদায়ী, সঙ্কট তুঙ্গে

শরীরের পঞ্চাশ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। প্রাথমিক চেষ্টায় ডাক্তারেরা রোগীকে প্রাণে বাঁচাতে পারলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওষুধটি না-পেলে শেষ রক্ষা হবে না।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৬ ০৪:৩৬
Share:

শরীরের পঞ্চাশ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। প্রাথমিক চেষ্টায় ডাক্তারেরা রোগীকে প্রাণে বাঁচাতে পারলেও জানিয়ে দিয়েছিলেন, ওষুধটি না-পেলে শেষ রক্ষা হবে না।

Advertisement

বাড়ির লোক হাতে টাকা নিয়ে হন্যে হয়ে খুঁজেছেন এক সপ্তাহ ধরে। জীবনদায়ী সেই হিউম্যান অ্যালবুমিন সিরাম কোথাও মেলেনি। ডাক্তারেরাও চেষ্টা করে পাননি। শেষমেশ গত সপ্তাহে দগ্ধ রোগীটির মৃত্যু হয়েছে কলকাতার অন্যতম এক মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।

কি়ডনি প্রতিস্থাপন করাতে যাওয়া এক তরুণীও এই পরিস্থিতির বলি। উল্টোডাঙার কাছে এক হাসপাতালে তিনি টানা তিন সপ্তাহ ভর্তি ছিলেন। অবস্থা দ্রুত খারাপ হতে থাকে। তাঁরও হিউম্যান অ্যালবুমিন সিরাম দরকার ছিল। মেলেনি। হাসপাতালও জোগাড় করে উঠতে পারেনি। দিন কয়েক আগে মেয়েটি মারা গিয়েছেন। ডাক্তাররা জানিয়েছেন, সিরাম দিতে না-পারাটাই মৃত্যুর কারণ।

Advertisement

একটা-দু’টো নয়। হাতের কাছে এমন উদাহরণ কয়েকশো মজুত। হিউম্যান অ্যালবুমিন সিরামের সঙ্কট চলছে দেশ জুড়ে। আগুনে পোড়া রোগীর চিকিৎসায় কিংবা যে কোনও বড় অস্ত্রোপচারে অতি আবশ্যিক ওষুধটির এত টানাটানি কেন?

চিকিৎকদের সিংহভাগের দাবি— জীবনদায়ী ওষুধের দাম বাঁধতে গিয়ে ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি যে নির্দেশ জারি করেছে, হিউম্যান অ্যালবুমিনের আকাল তারই জের। হাসপাতাল ও বিক্রেতা-সূত্রের খবর: আগে ওষুধটির দাম ছিল সাড়ে প্রায় চার হাজার টাকা। ২০১৩-য় ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’র নির্দেশে তা এক ধাক্কায় কমে দাঁড়ায় ৩২০০ টাকায়। সরকারি হাসপাতালে হাজার দেড়েকে পাওয়ার কথা। কিন্তু তখন ওষুধটির উৎপাদনও আচমকা কমে যায়। ক্রমে তা বাজার থেকেই উধাও হয়ে গিয়েছে। যার পিছনে ব্যবসায়িক কারণ দেখতে পাচ্ছেন চিকিৎসক ও হাসপাতাল পরিচালকদের অনেকে।

পরিণাম যা হওয়ার তা-ই। সিরামের জন্য হাহাকার। মৃত্যু। দিল্লির এক হাসপাতালের এক ডাক্তারের আক্ষেপ, “লিভার প্রতিস্থাপনের প্রতিটা অপারেশনে ১০ থেকে ৩০ ইউনিট হিউম্যান অ্যালবুমিন দরকার। এক ইউনিটও পাচ্ছি না। অপারেশন আটকে থাকছে।” রাজ্যের ওষুধ বিক্রেতা সংগঠন ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর কর্তারা বলছেন, এমন একটা জীবনদায়ী ওষুধ যে এ ভাবে মাসের পর মাস অমিল হতে পারে, সেটা ভাবা যায় না। ‘‘লাইফ সেভিং ড্রাগের দাম বাঁধতে গিয়ে ওষুধটাই যদি নাগালের বাইরে চলে যায়, তা হলে লাভটা কী?’’— প্রশ্ন তাঁদের।

এবং পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুতকারীদের দিকে যেমন আঙুল উঠছে, তেমন কেন্দ্রীয় ভূমিকাও পড়ছে সমালোচনার মুখে। ‘‘দাম কমে যাওয়ায় ওষুধ কোম্পানিগুলো লাভ করতে পারছে না। দু’-একটা বাদে সবাই উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে।’’— অভিযোগ অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সুবোধ ঘোষের। তাঁর মন্তব্য, ‘‘আমাদের সর্বভারতীয় সংগঠনের তরফে দিল্লিকে বারবার বলা হচ্ছে। সরকার দফায় দফায় বৈঠক করছে। তবু সুরাহা হচ্ছে না।’’ মওকা বুঝে কালোবাজারিও মাথা চাড়া দিয়েছে। সুবোধবাবুর কথায়, ‘‘কোথাও কোথাও অ্যালবুমিন সিরাম কয়েক গুণ বেশি দামে বিকোচ্ছে। বড় কিছু দোকান নজর এড়িয়ে চড়া দাম নিচ্ছে।’’ ড্রাগ কন্ট্রোল কী করছে? তাদের কন্ঠেও অসহায়তার সুর। ‘‘সারা দেশে এই অবস্থা। বারবার বিক্রেতাদের ডেকে পাঠিয়ে কথা বলছি। দিল্লিকে চিঠি দিয়েছি। দিন কয়েকের মধ্যে ফের বৈঠক রয়েছে। সমাধান করতেই হবে।’’— বলেন রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলার চিন্তামণি ঘোষ। অন্য দিকে প্রস্তুতকারীরা দায় এড়াচ্ছে। দামের কারণে উৎপাদন ছাঁটাইয়ের অভিযোগ উড়িয়ে একটি সংস্থার দাবি— সিরামটি বানানো হয় রক্তের প্লাজমা থেকে। রক্তের জোগানে মাঝেমধ্যে টান পড়ছে। তাতেই সমস্যা।

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মাথারা অবশ্য এ যুক্তি মানতে চাইছেন না। মন্ত্রকের এক শীর্ষ কর্তার প্রতিক্রিয়া, ‘‘মিথ্যে দাবি। রক্তের জোগানে এমন কিছু ঘাটতি নেই যে, উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে।’’ ওঁরা জানিয়েছেন, শিগগিরই ফের বৈঠক ডাকা হচ্ছে। সেখানে প্রস্তুতকারীদের স্পষ্ট বলে দেওয়া হবে, উৎপাদন বন্ধ করলে কপালে শাস্তি অবধারিত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন