পুরনো ভোটার তালিকায় চলছে বাবা-ঠাকুরদার নামের সন্ধান। রাজ্য লেখ্যাগারের দফতরে। ছবি: শৌভিক দে।
‘‘আমার জন্ম কলকাতায়, আর মেয়ে হয়ে গেল বিদেশি?’’
নাগাড়ে বিড়বিড় করে চলেছেন বেঁটেখাটো, রোগাটে প্রবীণ। তিনি দমদমের বাসিন্দা গৌতম চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাবা সাবেক রিপন কলেজের ছাত্র ছিলেন। মেয়ে সুচেতার নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য ৬৯ বছরের বৃদ্ধকেই মাঠে নামতে হয়েছে।
জামাই ধুবুড়ির বিলাসীপাড়ার বাঙালি। চাকরি সূত্রে গুয়াহাটির বাসিন্দা। মেয়ে ও বর, দু’জনেরই নাম তালিকায় রয়েছে। অথচ, সুচেতা জাতীয় নাগরিকপঞ্জির খসড়া তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। অগত্যা ১৯৭১ সালে নিজের বয়স কত ছিল, সেই হিসেব কষছেন গৌতমবাবু। তখন মেরেকেটে একুশ-বাইশের সেই তরুণের নাম ভোটার তালিকায় উঠেছিল তো? তবে নিজের, নয়তো নিজের স্বর্গীয় পিতার কারও একটা নাম পুরনো ভোটার তালিকা থেকে উদ্ধার করতে বদ্ধপরিকর গৌতমবাবু। তাঁর কন্যার এই বাংলার ভোটার কার্ড রয়েছে। কিন্তু তাতে কী? অসমে থাকতে হলে এ রাজ্যের পুরনো ভোটার তালিকায় থাকা বাপ-পিতেমোর যোগসূত্রটুকুই এখন সম্বল অসংখ্য বাংলাভাষীর। ভরা বাদলায় মেয়ের জন্য এই সন্ধানের তাগিদই বৃদ্ধকে টেনে এনেছে পশ্চিমবঙ্গ লেখ্যাগার অধিকরণ বা স্টেট আর্কাইভস ডিরেক্টরেট-এর দফতরে।
৪৫ নম্বর শেক্সপিয়র সরণির ঝকঝকে অফিসটার দোতলায় রাতারাতি আছড়ে পড়েছে দেশ হারানোর উৎকণ্ঠা। লখিমপুরের শাঁখা বিক্রেতা সুনীল বিশ্বাসের চোখে জল, ‘‘আমার বাবা জ্যোতিন্দ্র বিশ্বাস কোচবিহারের ভোটার ছিলেন। অসমে আগে আমিও ভোট দিয়েছি। আর আমায় কি না ‘ডি-ভোটার’ করে দিল!’’ অসমের নাগরিকপঞ্জি তৈরির কাজ শুরু হওয়া থেকেই ভিড় বাড়ছিল এখানে। চূড়ান্ত খসড়া তালিকা প্রকাশের পরেও জড়ো হচ্ছেন ‘না-নাগরিক’রা। দফতরের কর্তাব্যক্তিদের আশঙ্কা, আগামী কয়েক দিনে এ তল্লাটে নামপরিচয় হাতড়ানোর ভিড়টা আরও বাড়বে। গত দু’-তিন বছরে এই বাড়ি থেকে অন্তত শ’পাঁচেক লোকের পিতৃপুরুষের নাগরিকত্বের নথি উদ্ধার হয়েছে। স্টেট আর্কাইভসের সহ-অধিকর্তা সুবোধচন্দ্র দাস বলছিলেন, ‘‘এমনও দেখছি, কোলেকাঁখে বাচ্চাসুদ্ধ এক-একটি পরিবার সিঁড়ির চাতালে বসে থাকছে।’’
১৯৫২, ’৬৬ বা ’৭১-এর জাবদা ভোটার খাতায় ঝুঁকে পড়ে খড়ের গাদায় ছুচ খোঁজা চলছে নিরন্তর। কানে ফোন, দাড়িওয়ালা প্রৌঢ় জানতে চান, ‘‘হ্যাঁ রে, খৈরুদ্দিনের বৌয়ের নাম আম্বিয়া খাতুন ছিল তো? বলিস কী, মোবারকের বাপের নাম নিল মহম্মদ নয় বুঝি?’’ কোচবিহারের কোর্টের কেরানি আনোয়ার হুসেন ম্লান হাসেন, ‘‘আমার উপরে গোটা পাড়ার দায়িত্ব, বুঝলেন!’’ কোচবিহারের ভূমিপুত্র খৈরুদ্দিনের নাতনি কিংবা মোবারকের মেয়েরা বিয়ের পরে কেউ কোকরাঝাড়, কেউ ধুবুড়িবাসী। নাগরিকপঞ্জিতে নাম নেই কারও। ১৯৭০-এর দশকে জেনকিন্স স্কুলের এক শিক্ষকের মৃত্যু নিয়ে গোলমালে কোচবিহারের জেলাশাসকের অফিস জ্বালিয়ে দিয়েছিল ক্ষুব্ধ জনতা। জেলার বিধানসভা কেন্দ্রগুলির পুরনো ভোটার তালিকাও তখন পুড়ে যায়। অগত্যা কলকাতার লেখ্যাগারের নথিই ভরসা। এক আধিকারিক বলছিলেন, ‘‘কেউ নির্দিষ্ট পার্ট নম্বর, বুথ নম্বর বলতে পারলে কম্পিউটারে আমরাই খুঁজে দিচ্ছি। তবে বেশির ভাগকেই খাতা ঘেঁটে নাম বার করতে হচ্ছে।’’
তেজপুরের দেবাশিস সূত্রধরের বন্ধু কলকাতাবাসী শৌভিক সাউ বা গোয়ালপাড়ার লক্ষ্মী ঘোষের দাদা, বারাসতের জীবন চৌধুরীরা মরিয়া হয়ে খুঁজে চলেছেন। একদা আলিপুরদুয়ারের স্কুলে ক্লাস ফোর পাশ, অধুনা অসমের লখিমপুরবাসী, নামমাত্র শিক্ষিত সুনীল বিশ্বাস ইতিমধ্যে ভোটাধিকার খুইয়েছেন। পুরনো ভোটার তালিকায় বাবার নামটা খুঁজে পেয়েও ভয় যাচ্ছে না তাঁর। প্রথম বার কলকাতা দেখে গুয়াহাটির ট্রেন ধরার তাড়ার মুখে জড়োসড়ো ভঙ্গিতে বারবার জানতে চাইছিলেন, ‘‘এতেই হবে তো বাবু! আমার নামটা লিস্টে উঠবে তো আবার!’’