মন্ত্রীর আশ্বাসই সার। বেশির ভাগ রুটেই ইচ্ছে মতো ভাড়া নিলেন অটোচালকেরা। পুজোর আগে আর এক দফা ভাড়া বাড়ানোর হুমকিও দিয়ে রাখলেন। মন্ত্রীকে পাল্টা চ্যালেঞ্জ করে চালক থেকে মালিকেরা বললেন, ‘‘নেতা-মন্ত্রী চিনি না। আমরা গান বাজাব। যেমন বুঝব, তেমন ভাড়াও নেব। ক্ষমতা থাকলে কিছু করে দেখাক।’’
অর্থাৎ, অটো নিয়ন্ত্রণে প্রথম পদক্ষেপেই বড়সড় ধাক্কা খেল রাজ্য সরকার।
মঙ্গলবার অটো নিয়ন্ত্রণে দফতরের কর্তাদের নিয়ে বৈঠকের পরে পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী জোর গলায় ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘আমি আশ্বস্ত করছি অটোয় আর বেশি ভাড়া নেওয়া হবে না। খোঁজ নিয়ে দেখুন ইতিমধ্যেই বর্ধিত ভাড়া নেওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছে।’’ এ প্রসঙ্গে নির্দিষ্ট একটি রুটের উল্লেখও করেন মন্ত্রী।
এ দিন ওই নির্দিষ্ট রুটে গিয়ে দেখা গেল, মাসখানেক আগে সেখানে প্রতি ধাপে এক টাকা করে যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল, তা বহাল রয়েছে। অটোচালকেরা জানিয়ে দিচ্ছেন, ইউনিয়ন তাঁদের সঙ্গে রয়েছে। সুতরাং, ভাড়া কমানোর প্রশ্নই ওঠে না।
শুধু দক্ষিণের ওই নির্দিষ্ট রুটই নয়, কলকাতার সব প্রান্তেই এ দিন দেখা গেল একই চিত্র। মন্ত্রী যেখানে বসে ওই ঘোষণা করেছিলেন, সেই রুবি মোড় থেকে বালিগঞ্জ স্টেশন অটোরুটে কয়েক দিন আগেই ৬, ৭ এবং ৮ টাকা ভাড়া একধাপে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০ টাকা। ১০ টাকার ভাড়া বাড়িয়ে করা হয়েছে ১২। এ দিনও দেখা গেল সেই ভাড়াই চলছে।
এ ছাড়া, সল্টলেকের করুণাময়ী থেকে সিটি সেন্টার হয়ে উল্টোডাঙা স্টেশন রুটে ভাড়া ১২ টাকার বদলে ১৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ। ১৪ নম্বর ট্যাঙ্ক থেকে উল্টোডাঙা স্টেশন, বেলেঘাটা বাইপাস কানেক্টর থেকে বৈশাখী মোড় পর্যন্ত ভাড়া এক লাফে ১৫ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ২০ টাকা। উল্টোডাঙা থেকে এসডিএফ মোড়ের ভাড়া ২০ টাকার জায়গায় ৩৫ টাকা নেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, অটো যানজটে পড়লে সেই দায়ও নিতে হয় যাত্রীদেরই। নিত্যযাত্রীদের অভিযোগ, শোভাবাজার থেকে উল্টোডাঙা পর্যন্ত ভাড়া ১০ টাকা। কিন্তু যানজটে পড়লেই তা হয়ে যায় ১৫ টাকা। অটো চালকদের যুক্তি, যানজটে আটকে পড়লে তাঁদের আর্থিক ক্ষতি হয়।
তৃণমূলের অটো ইউনিয়নের নেতারা অবশ্য দাবি করেছেন, এ দিন না হলেও কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। দক্ষিণ কলকাতায় তৃণমূল অটো ইউনিয়নের নেতা গোপাল সুতার যেমন বলেন, ‘‘সরকার ও মন্ত্রীর নির্দেশ মানতে আমরা দায়বদ্ধ। এ দিনও আমরা রাস্তায় নেমে অটো চালকদের বর্ধিত ভাড়া নিতে বারণ করেছি।’’
সম্প্রতি পর পর কয়েকটি ঘটনায় অটোর দাদাগিরি ও বেপরোয়া মনোভাবের সাক্ষী থেকেছে এই শহর।
কলকাতার গৌরীবাড়িতে সিগন্যাল অমান্য করে বাসে ধাক্কা মারায় মৃত্যু হয় পূজা পাল নামের এক কলেজ ছাত্রীর। তার পরে খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের সঙ্গে বচসা এবং তাঁর নিরাপত্তা রক্ষীকে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে মধ্য কলকাতায়। পর দিন ঠিক একই জায়গায় এক পুলিশ কর্মীকে রাস্তায় ফেলে মারধর করা হয়। তার পরেই তড়িঘড়ি মঙ্গলবার পরিবহণ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী। কিন্তু তাতে ফল হয়নি বলেই দাবি করেছিলেন দফতরের কর্তাদের একাংশ। বুধবার সেটাই হাতে নাতে প্রমাণ দিলেন অটো চালকেরা।
কেন এমন পরিস্থিতি? পরিবহণ দফতরের কর্তাদের মতে, ইউনিয়নের রমরমাই এই পরিস্থিতির আসল কারণ। দুর্গাপুজোর ঠিক আগে ভাড়া কমিয়ে দিলে অটো চালকেরা ক্ষুব্ধ হবেন বলে মনে করছেন তৃণমূলের অটো ইউনিয়নের নেতারা। তাই দলীয় স্তরের নেতারা এ নিয়ে বিশেষ ঘাঁটাঘাঁটি করতে চান না। নবান্নের এক কর্তার কথায়, ‘‘পুজোর আগে এ নিয়ে জলঘোলা চান না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। সে জন্যই, মঙ্গলবার মন্ত্রী প্রথমে পুলিশের সঙ্গে বসার ইচ্ছে প্রকাশ করলেও শেষমেশ শুধু পরিবহণ কর্তাদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। অটোর দাদাগিরি রুখতে কড়া হওয়ার নির্দেশ পুলিশকেও দেওয়া হয়নি। ফলে পুলিশ সক্রিয় হয়নি। অটোও রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরে।’’
মন্ত্রী নিজে অবশ্য এ নিয়ে কোনও মন্তব্যেই নারাজ। অটোর ভাড়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি কোনও মন্তব্য করব না।’’
পরিবহণ দফতরের দাবি, অটো-নীতি কী করা যায়, তা নিয়ে পুজোর পরে ফের আলোচনা হবে। আপাতত কলকাতা, ব্যারাকপুর, বিধাননগর ও হাওড়া কমিশনারেটের অটো, বাস ও মিনিবাসের রুটগুলিকে এক ছাতার তলায় আনতে চাইছে তারা। সে কারণে ওই এলাকার সব আঞ্চলিক পরিবহণ অফিসকে আরটিএ কলকাতার অধীনে নিয়ে আসা হচ্ছে। এতে সমন্বয় বাড়বে বলে দাবি পরিবহণ-কর্তাদের। কিন্তু অটো-রাজ যে কমবেই, এমন কথা হলফ করে বলতে পারছেন না তাবড় পরিবহণ কর্তারা।