চলছে বেবি ফুটবল লিগ। ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম
সেই দামাল পা। সেই দুরন্ত দৌড়। সেই হার না মানা জেদ। শুধু বদলে গিয়েছে বলটা!
নবাবের জেলায় বোমাকে বল ভেবে খেলতে গিয়ে কত যে অঘটন ঘটেছে তার ইয়ত্তা নেই। গাছের বেল, ঝুনো নারকেল, পড়ে থাকা কয়েতবেল কিংবা বাতাবি লেবু নিয়ে রুখু রাস্তায় খেলতে গিয়েও হাত-পা ছড়েছে বহু বার।
মুর্শিদাবাদের ইসলামপুরে খুদেদের পায়ে এ বার সত্যিকারের ফুটবল। স্কুল থেকে ফিরেই সাদাকালো খোপকাটা বল নিয়ে তারা ছুটছে সবুজ মাঠে। আর সেই খুদেদের মাঠে পৌঁছে দিচ্ছেন তাদের মায়েরা। এক হাতে জার্সি, বুটের ব্যাগ। অন্য মুঠোয় ছেলের হাত। হাঁটাপথে ছিটকে আসছে, ‘‘কী গো ইমামের মা, ছেলেকে নিয়ে মাস্টারের বাড়ি চললে নাকি?’’ একগাল হাসছেন রুবিনা বিবি, ‘‘বিকেলে আবার পড়া কী? ছেলে খেলবে। পৌঁছে দিতে যাচ্ছি।’’
মাঠে পৌঁছে দিয়েই কাজ শেষ হচ্ছে না। নিজে হাতে ছেলেকে জার্সি পরিয়ে দিচ্ছেন মা। শক্ত করে বেঁধে দিচ্ছেন বুটের ফিতে। তার পরে ওই আটপৌরে মহিলাদের কেউ মাঠের বাইরে থেকে গলা ফাটাচ্ছেন, ‘‘এত কাটানোর দরকার নেই। বলটা পাস কর বাবু।’’ কেউ উত্তেজনায় ফুটছেন, ‘‘ওরে, দূর থেকে শট নিবি না।’’ প্রত্যন্ত গ্রামে আইএফএ পরিচালিত এই বেবি ফুটবল লিগকে ঘিরে আশায় বুক বাঁধছেন বাবা-মায়েরা। তাঁরা বলছেন, ‘‘সবাই তো আর ডাক্তার, মাস্টার, ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। ছেলেদের ফুটবল অন্তপ্রাণ। তাই খেলেই যদি কিছু করতে পারে, করুক।’’
আরও পড়ুন: শিবরাজের তরী বাঁচবে তো? চিন্তায় অমিত
কথাটা কিন্তু কথার কথা নয়। বেবি লিগে গুরুদক্ষিণা পাঠশালার হয়ে খেলছে বহরমপুরের অঙ্কুশ বাগচী। বছর নয়েকের ছেলেকে নিয়ে চৈতালি বাগচী প্রথমে এক কিলোমিটার টোটো ও পরে প্রায় ২৫ কিলোমিটার বাসযাত্রা শেষে পৌঁছন ইসলামপুরে। সেখান থেকে ফের এক কিলোমিটার হেঁটে তার পরে মহামায়া মাঠ। চৈতালি বলছেন, ‘‘ফুটবলের জন্য রান্নাবান্না ও সংসার সামাল দিতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। তা হোক। তাই বলে ছেলের জন্য এটুকু করব না?’’ চৈতালি এক নন, কালিকাপুরের সঞ্জিলা বিবি, গোয়াসের রুবিয়া বিবিরাও ছেলেদের নিয়ে নিয়মিত মাঠে আসছেন। রুবিয়া বলছেন, ‘‘ফুটবল ইমামুদ্দিনের নেশা। বড় হয়ে যদি সেটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেয়, ক্ষতি কী?’’
আরও পড়ুন: ডাকের বাক্স খালিই, আর আসে না চিঠি
বেবি লিগ কমিটির কার্যকরী সভাপতি ধীমান দাস ও বেবি লিগ অপারেটর আমিনুল ইসলামেরা জানাচ্ছেন, ইসলামপুর, নবদ্বীপ ও রাজারহাট— এই তিন জায়গায় বেবি ফুটবল লিগ চলছে। ইসলামপুরে আট থেকে তেরো বছর বয়সের ছেলেদের নিয়ে ২৪টি দলে প্রায় ২৫০ জন খুদে খেলোয়াড় এখন খেলছে। তাঁর কথায়, ‘‘ফুটবল নিয়ে উন্মাদনা গাঁ-গঞ্জেও আছে। কিন্তু ছেলেদের নিয়ে মায়েরা মাঠে আসছেন, এমন দৃশ্য দেখিনি।’’
স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে মোবাইল নয়, কার্টুন নয়, বই-খাতা নিয়ে টিউশন নিতেও নয়, পায়ে বল নিয়ে ওরা ছুটছে তেকাঠির দিকে। মাঝে-মধ্যেই সমস্বরে ‘গো...ও...ও...ও...ল’ আওয়াজে বদলে যাচ্ছে প্রান্তিক গ্রামের চেনা বিকেল।