জামার টাকায় বই কিনতেন সফল সংযুক্তা

এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সামগ্রিক ভাবে দ্বিতীয় হয়েছেন সেই মেয়ে সংযুক্তা বসু। মা চৈতালীদেবী বললেন, ‘‘মেয়েটা অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। টানা দু’বছর ধরে পড়াশোনা করে গিয়েছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৯ ০৩:৪২
Share:

মায়ের সঙ্গে সংযুক্তা বসু। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

‘‘এ বার পাঠশালা বন্ধ করে শুতে যা,’’ মেয়েকে বলতেন মা। মেয়ে শুনতেন না। পড়তেন রাত জেগে। পাঠশালা বন্ধ হত না।

Advertisement

এ বার উচ্চ মাধ্যমিকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সামগ্রিক ভাবে দ্বিতীয় হয়েছেন সেই মেয়ে সংযুক্তা বসু। মা চৈতালীদেবী বললেন, ‘‘মেয়েটা অমানুষিক পরিশ্রম করেছে। টানা দু’বছর ধরে পড়াশোনা করে গিয়েছে। একটু কম পড়তে বলতাম। বলতাম, ‘বাড়ির পাঠশালাটা এ বার কিছু ক্ষণের জন্য বন্ধ কর’। শুনত না। পরিশ্রমের ফল পেয়েছে ও।’’

বাগুইআটির অশ্বিনীনগরে ছোট্ট ফ্ল্যাটে মা, এক মাসি আর দিদার সঙ্গে থাকেন সংযুক্তা। বিধাননগর সরকারি স্কুলের সফল ছাত্রীটি বললেন, ‘‘সকাল ১০টায় টিভিতে মেধা-তালিকা প্রকাশ করা হবে, জানতাম। কিন্তু মাকে টিভি খুলতে বারণ করেছিলাম। আমার বন্ধু অভিজ্ঞানই প্রথম খবর দেয়। ওর কাছেই জানতে পারি, ৪৯৬ পেয়ে মেয়েদের মধ্যে প্রথম, সার্বিক ভাবে দ্বিতীয় হয়েছি।’’

Advertisement

বাবা কর্মসূত্রে বাইরে থাকেন। চৈতালীদেবী জানান, স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ কমই হয়। একাই মেয়েকে মানুষ করেছেন। বাড়িতে আছেন চৈতালীদেবীর দিদি টুকটুকি সিংহ ও মা সন্ধ্যারানি সিংহ। টুকটুকিদেবী কথা বলতে পারেন না। তবে বোনের মেয়ের ভাল ফলের খবরে তাঁর আনন্দ ধরে না। ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন, আজ তিনি সব থেকে খুশি। সন্ধ্যাদেবী বলেন, ‘‘নাতনির সঙ্গে আমার মেয়েও রাত জাগত। গত কয়েক বছর ধরে ঘরে-বাইরে ওরা কত রকম আর্থিক প্রতিবন্ধকতার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু কখনও দমে যায়নি।’’

বাড়ি বাড়ি ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে সংসার চলে চৈতালীদেবীর। আর বাড়িভাড়া থেকে প্রতি মাসে কিছু টাকা আসে। তিনি বললেন, ‘‘বাড়িতে যে আর্থিক কষ্ট আছে, মেয়ে তা জানত। তাই কখনও কোনও চাহিদা ছিল না।’’ চৈতালীদেবী জানান, একাদশ শ্রেণিতে ওঠার পরে মেয়ে তাঁকে বলেছিলেন, আগামী দু’বছর ওঁকে কোনও জামাকাপড় কিনে দিতে হবে না। জামাকাপড়ের জন্য বরাদ্দ কিছু টাকায় যেন বই কিনে দেন। চৈতালীদেবী বলেন, ‘‘গত দু’বছর দিনরাত এক করে পড়েছে ও। পুজোর সময় শুধু অষ্টমীতে অঞ্জলি দিতে মণ্ডপে গিয়েছিল। দু’বছর কোথাও বেড়াতে যায়নি। এক বার শুধু স্কুলের শিক্ষাভ্রমণে গিয়েছিল। সেখানেও গিয়েছিল একগাদা বই নিয়ে।’’

সংযুক্তা জানান, তিনি রাতদিন পড়াশোনা করেছেন ঠিকই। তবে ফাঁকে ফাঁকে সিনেমা দেখেছেন, পড়েছেন গল্পের বইও। ব্যোমকেশ-ভক্ত সংযুক্তা বলেন, ‘‘উদ্বুদ্ধ করে, এমন গল্পের বই বা সিনেমা ভাল লাগে।’’ গত রবিবার রাতে তিনি প্রিয়ঙ্কা চোপড়া অভিনীত মেরি কম দেখেছেন। ‘‘মহেন্দ্র সিংহ ধোনির জীবন নিয়ে সুশান্ত সিংহ রাজপুত অভিনীত এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি আমার খুব প্রিয়। এই ছবিটি খুব উদ্বুদ্ধ করে,’’ বললেন সংযুক্তা।

ভবিষ্যতের পড়ুয়াদের জন্য সফল দিদির পরামর্শ, নিজেকে সুস্থ রেখে সারা বছর পড়তে হবে। পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়তে হবে। মা, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকা ছাড়া এত ভাল করা সম্ভব ছিল না, জানাচ্ছেন সংযুক্তা। অর্থনীতি পড়তে চান তিনি। পরিস্থিতি অনুকূল হলে পড়তে চান লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে। সংযুক্তা অর্থনীতির উচ্চতর পাঠ নিতে চাওয়ায় শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় খুব খুশি। বলেন, ‘‘আমি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমার মেয়েও লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের ছাত্রী। সংযুক্তাকে জানিয়েছি, ওর উচ্চশিক্ষা, গবেষণার ক্ষেত্রে সব রকম সাহায্য করব।’’

সোমবার বিকেলে নিজের স্কুলে যান সংযুক্তা। স্কুলের টিচার ইনচার্জ তারাপদ সাঁতরা, সংযুক্তার ক্লাসটিচার জয়শ্রী বাগচী, অর্থনীতির শিক্ষিকা শাঁওলী চক্রবর্তী বললেন, ‘‘এত ভাল পড়াশোনায়, কিন্তু কোনও অহঙ্কার নেই। খুবই বিনয়ী মেয়ে সংযুক্তা।’’

স্কুলের ফটক দিয়ে ঢুকেই দেখা যায়, একটি কাঠের বোর্ডে স্কুলে সফল পড়ুয়াদের নাম খোদাই করা আছে। বোর্ডে এ বার সংযুক্তার নাম খোদাই করা হবে বলে জানান শিক্ষকেরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন