সাড়ে তিন দশকের বাম জমানায় মুর্শিদাবাদ জেলা তাঁর সাম্রাজ্য বলেই চিহ্নিত ছিল। দু-এক বার ‘দাঁত ফোটানো’র চেষ্টা যে হয়নি, এমন নয়। তবে অধীর চৌধুরীর গড়ে সে দংশন তেমন গভীর ক্ষত তৈরি করতে পারেনি।
বিধানসভা ভোটের পরে গত কয়েক মাসে সেই গড়েই আছড়ে পড়েছে ভাঙনের গভীর ধাক্কা। এ বার প্রদেশ কংগ্রেস সেনাপতির কলজেটাই ছিনিয়ে নিল তৃণমূল! তৃণমূলের যুব সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে রবিবার শাসক দলে নাম লেখালেন বহরমপুর পুরসভার চেয়ারম্যান নীলরতন আ়ঢ্য-সহ ১৭ জন কংগ্রেস কাউন্সিলর। আর বহরমপুরে শুভেন্দু অধিকারীর সভা-মঞ্চে যোগ দিয়েছেন আরও এক জন। খাতায়-কলমে মুর্শিদাবাদ আর কান্দি পুরসভা ছাড়া কিছু আর নেই অধীরের ঝুলিতে। কিন্তু সে নিছকই সংখ্যার মায়া! বহরমপুর অধীরের হাতছাড়া হওয়া মানে কলজে হারিয়ে ভেন্টিলেশনে বেঁচে থাকা!
পালাবদলের পরে, তৃণমূলের প্রথম পাঁচ বছরেও অধীরের চিরাচরিত দাপটে টোল পড়েনি। শাসক দলের কোনও প্যাঁচই কাজে না দেওয়ায় অন্যত্র ঘন ঘন প্রশাসনিক সভা কিংবা দলীয় সমাবেশ করে বেড়ালেও বার কয়েক পা রেখেই মুর্শিদাবাদ থেকে পিছু হটেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছিলেন ইন্দ্রনীল সেনের মতো অরাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে দিয়ে। দু’বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে ইন্দ্রনীলকেই সাড়ে তিন লক্ষেরও বেশি ভোটে হারিয়েছিলেন অধীর। গত বিধানসভা ভোটের প্রচারে বহরমপুরের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রীর আবেদন ছিল, ‘‘অন্তত এক বার আমায় সুযোগ দিয়ে দেখুন, মুর্শিদাবাদের উন্নয়ন করতে পারি কি না!’’ তার পরে সেই বহরমপুর বিধানসভা কেন্দ্রেই কংগ্রেস প্রার্থী, অধীর-ঘনিষ্ঠ মনোজ চক্রবর্তী জয়ী হন ৯২ হাজারেরও বেশি ভোটে!
তা হলে মাত্র কয়েক মাসেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল অধীরের গড়? আহিরণ, বেলডাঙা, জিয়াগঞ্জ-আজিমগঞ্জ পুরসভা খুইয়ে দিশেহারা অবস্থাতেই ভেঙে গিয়েছে অধীরের সাধের জেলা পরিষদও। জেলা কংগ্রেসে এক অধীর-ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘হাঁটু, কোমর, পাঁজর একে একে সবই খুইয়ে ছিলেন দাদা। এ বার কলজেটাও গেল!’’ যে বহরমপুর তাঁর বেড়ে ওঠা এবং রাজনীতির আঁতুড়ঘর, যেখান থেকে তাঁর ‘রবিনহুড’ তকমা উপার্জন, সেখানে এই ধাক্কা মর্মান্তিকই বটে!
অধীরের ব্যাখ্যা, ‘‘যাঁরা দলবদল করেছেন, তাঁদের অনেককেই তৃণমূলে যোগ না দিলে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে। মোটা টাকার টোপও দেওয়া হয়েছে, কাউকে চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও। পুলিশ-প্রশাসন মাঠে নেমেছে। অধিকাংশই সাধারণ ঘর থেকে উঠে আসা মানুষ। এই লোভটা এড়িয়ে যেতে পারেননি ওঁদের অনেকে।’’ জনপ্রতিনিধিরা দল ছাড়়লেও জনগণ তাঁর সঙ্গে আছে, বোঝাতে আজ বহরমপুর শহরের উত্তর প্রান্তের কুঞ্জুঘাটা থেকে দক্ষিণে গোরাবাজার পর্যন্ত মিছিলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা অধীরের।
বর্তমান কংগ্রেসে নিজের ক্যারিশমায় জয় হাসিল থেকে শুরু করে জনভিত্তিসম্পন্ন নেতা বলতে এক জনকেই বোঝাত। প্রদেশ সভাপতি হওয়ার পরেও মুর্শিদাবাদ-কেন্দ্রিক রাজনীতি থেকে তিনি বেরোতে পারেননি, এমন অভিযোগ উঠেছে কংগ্রেসেই। অথচ শাসকের দাপটে কংগ্রেস না অক্ষত থাকল অবশিষ্ট বাংলায়, না মুর্শিদাবাদে! তৃণমূলে যোগ দিয়ে জেলা কংগ্রেসেরই কেউ কেউ আক্ষেপ করেছেন, ‘দাদা’কে আর আগের মতো ডাকলেই পাশে পাওয়া যায় না। দলের একাংশের দাবি, বিধানসভায় সিপিএমের সঙ্গে হাত মেলাতে গিয়ে নিজের গড়েও বিপদ ডেকে আনলেন অধীর। ইতিহাসের পরিহাস এমনই যে, রাজনীতিতে তাঁর চেয়ে ঢের অনভিজ্ঞ অভিষেকের কাছেও এখন শুনতে হচ্ছে— ‘‘অধীর চৌধুরী তো মুর্শিদাবাদে নিজের গড়ই সামলাতে পারেন না! ওঁর তো প্রদেশ সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেওয়া উচিত!’’