মারা গেলেন যুদ্ধ কর্মকার। রাষ্ট্রপতির হাত থেকে তাঁর পুরস্কার পাওয়ার ছবি আঁকড়ে স্ত্রী সাবিত্রী কর্মকার। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
ডোকরা গ্রামে এলেই শিল্প রসিকরা সবার আগে তাঁর খোঁজ করতেন। —কেমন আছেন ডোকরা যাদুকর?
এমনই শুনতে শুনতে ছোট থেকে বড় হয়েছেন এ তল্লাটের ছেলেমেয়েরা। প্রশ্নটা অন্য শিল্পীদেরও গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল। তাই তাঁদের কাজ না দেখে আগন্তুকদের আগে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার জয়ী ডোকরা শিল্পী যুদ্ধ কর্মকারের খোঁজ করতে দেখে তাঁরা আর অস্বস্তিতে পড়তেন না।
প্রশ্নটা আর শোনা যাবে না। অনটনের সঙ্গে যুদ্ধ করে ডোকরাকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার অসম যুদ্ধ লড়তে লড়তে সেই মানুষটাই চলে গেলেন। রবিবার রাতে নিজের হাতে গড়া ডোকরা গ্রাম (লোকমুখে) অথবা শিল্পগ্রামেই (পোশাকি নাম) তিনি মারা যান। বয়স হয়েছিল ৬৮ বছর। এই ছন্দপতনে শোক নেমেছে ডোকরা-সহ সমস্ত শিল্পীদের মধ্যে।
পোড়ামাটির ঘোড়া জন্য যদি বাঁকুড়ার গর্ব হয়, তবে ডোকরা শিল্প বাঁকুড়ার অহঙ্কার। সেই সোনালি তারের জাদুতে ভুবন জয় করেছিলেন যুদ্ধবাবু। কিন্তু বার্ধক্য তাঁর আঙুলকে আর বশে রাখতে দেয়নি। বছর তিনেক ধরে কাজ করতে পারছিলেন না। তাই মনমরা হয়ে থাকতেন। ভরণপোষণের সম্বল ছিল বার্ধক্যভাতার সামান্য ক’টা টাকা। চলে গেলেন বয়সজনিত সমস্যায়।
সোমবার সকালে ডোকরা গ্রামে গিয়ে দেখা গেল যুদ্ধবাবুর দেহ দাহ করতে গ্রামের অনেকে শ্মশানে গিয়েছেন। শিল্পীদের কাজের জন্য সরকারের গড়ে দেওয়া আটচালায় কয়েকজন ডোকরা শিল্পী জটলা করছিলেন। সবারই মুখ শুকনো। ফিসফিস করে তাঁরা যুদ্ধবাবুর কাজের কথাই বলছিলেন। চারপাশে শুধুই স্মৃতির ঝাপটা। যার বেশির ভাগটাই ছিল এক শিল্পীর জীবন যুদ্ধের কাহিনি।
১৯৮৮ সালে চাঁদ সদাগর-এর কাহিনী আঁকা ডোকরার ‘মনসা ঘট’ বানিয়েছিলেন যুদ্ধবাবু। তার জেরেই ভাঙা ঘরে আসে রাষ্ট্রপতি পুরস্কার। গ্রামের আটচালায় সেই রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ও পুরস্কার পাওয়ার ছবি আঁকড়ে বসে থাকা যুদ্ধবাবুর স্ত্রী সাবিত্রীদেবী শোনাচ্ছিলেন সে দিনের কথা। তখন তিনি চার মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। স্বামী তৈরি করছেন মনসার ঘট। বাইরে অঝোরে শ্রাবণ। ভিজে ভিজেই কাঁচামাল স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন সাবিত্রীদেবী। কাজ শেষ হওয়ার পরে জেলা প্রশাসনের কাছে তা প্রদর্শনীর জন্য দেওয়া হল। বাংলা জয় করে সেই ঘট গেল দিল্লি। সেখানেও জয়। তিনি বলেন, “তখন আমরা প্রতাপবাগানে থাকতাম। একদিন একটা চিঠি এল। আমরা মুখ্যু লোক, পড়তে জানি না। পাড়ার এক শিক্ষিত বাবুকে ডেকে চিঠি পড়ালাম। চিঠি পড়েই যুদ্ধকে কোলে তুলে নিয়ে চিৎকার জুড়ে দিলেন সেই বাবু। এক নাগাড়ে বলে তিনি চললেন, ‘যুদ্ধ রাষ্ট্রপতি পুরষ্কার পাবে। তাঁকে দিল্লি গিয়ে পুরস্কার নিয়ে আনতে হবে।’ অন্য ডোকরা শিল্পীদের মধ্যে আলোড়ন পড়ে গেল সেই বিষয়টিকে নিয়ে।’’ ঝর ঝর করে জল গড়িয়ে পড়ল বৃদ্ধার চোখ থেকে। কিছুটা থেমে তিনি বলেন, “তখন আশপাশের এলাকায় দু’-একজনের বাড়িতে টিভি এসেছে। টিভিতে স্বামীর পুরস্কার পাওয়ার ছবি দেখতে আমরা ভিড় করেছিলাম।” স্মৃতির জাবর কেটে চলেন বৃদ্ধা।
পুরস্কার তো জুটল। কিন্তু তারপর? একরাশ ক্ষোভ নিয়ে সাবিত্রীদেবী বললেন, “কেউ দেখেনি, কেউ খোঁজ রাখেনি। সারা দিন চা খেয়ে রাতে আধপেটা ভাত জুটত আমাদের। শিল্প ছেড়ে চায়ের দোকানে কাজে ঢুকেছিলেন স্বামী। মেয়েটার তো বিয়ে দিতে হবে।” তিনি জানান, ১৯৯০ থেকে টানা বছর দশেক খুব খারাপ সময় গিয়েছে ডোকরা শিল্পীদের জন্য। অনেকেই এই পেশা ছেড়ে রাজমিস্ত্রি, চায়ের দোকানি, রিকশা চালানোর কাজ নিয়েছিলেন। তবে গত কয়েক বছরে ছবিটা বদলেছে। ডোকরা ধনী শিল্পরসিকের অন্দরমহলে আর আটকে নেই। এখন মধ্যবিত্তের মামুলি শোকেসেও শোভা ছড়াচ্ছে ডোকরা। উপহার হিসেবেও অনেকে ডোকরার শিল্পকৃত্তি তুলে দিচ্ছেন প্রিয়জনকে।
প্রবীণ শিল্পীরা জানান, এক সময় ডোকরা শিল্প বলতে অলঙ্কার বোঝাত। পরে পরে দেবদেবীর মূর্তি, ঘট বানানো শুরু হয়। এখন বাসপত্র থেকে দরজার গ্রিল সব কিছুই হচ্ছে ডোকরা দিয়ে। অনেক ব্যবসায়ী এগিয়ে এসে বিনিয়োগ করছেন ডোকরা শিল্পে। গ্রামের ডোকরা শিল্পী হরেন্দ্রনাথ রানা বলেন, “সরকারি নানা প্রকল্প ও বিনিয়োগকারীরা এগিয়ে আসায় ফের চাঙা হয়েছে ডোকরা শিল্প। আমরা নতুন উদ্যমে ফের কাজ শুরু করেছি।” একই কথা বলছেন শিল্পডাঙার ডোকরা শিল্পী নিতাই কর্মকার, সুধীর কর্মকাররাও। তাঁদের কথায়, “এক সময় মনে হতো এই শিল্পটা হয়তো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু সেই সব দিনেও যুদ্ধবাবুরা আমাদের কাজ করতে উৎসাহ দিতেন। তাঁর কথা আমরা ভুলব কি করে? কিন্তু আজ দিন বদলে সেই মানুষটাই নেই।’’
বাঁকুড়া শহর থেকে ১২টি ডোকরা শিল্পীর পরিবার আশির দশকে বিকনায় এসে কলোনি বানিয়ে বসবাস শুরু করেছিলেন। যুদ্ধবাবুই এই কলোনির নাম রেখে ছিলেন ‘শিল্প ডাঙা’। এখন এই শিল্প ডাঙায় পরিবার বেড়ে ৫৫। ঘরে ঘরে সকাল-সন্ধ্যা ডোকরার কাজ চলে। যুদ্ধবাবুর বড় ছেলে দাহ সেরে আটচালায় মায়ের পাশে এসে বসেন। তিনি বলেন, “কত কষ্ট করে বাবা আমাদের বড় করেছিলেন। সে দিন এই শিল্প পুরোপুরি ডুবে গিয়েছিল। বাবার আফসোস ছিল, কিন্তু আমাদের বলতেন যাই কর, মনে রাখিস এই শিল্পই তোর জীবন। বাবার কথাই সত্যি হল। ডোকরার সুদিন এসেছে। কিন্তু বাবাই আর নেই।”