কালীপুজোর পরেই দলে-দলে চলে আসেন তাঁরা। বর্ষা নামার আগে পর্যন্ত এটাই তাঁদের ঘরবাড়ি। সাত-আট মাস ইটভাটায় কাজ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সারা বছর চলে।
কালনায় ভাগীরথীর ধারে ইটভাটাগুলিতে এ বারও তেমনই চলে এসেছিলেন শ্রমিকেরা। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যে কেন্দ্রের এক ঘোষণায় তাঁরা পড়েছেন মহা ফ্যাসাদে। ইট বিক্রি হচ্ছে না। তাই মালিকেরা উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছেন। দৈনন্দিন খরচের টাকাও মিলছে কম। যে কোনও সময় ফিরে যেতে বলবেন মালিক, মনে করছেন শ্রমিকেরা। তখন বছরের বাকিটা কী ভাবে কাটবে, আশঙ্কায় তাঁরা।
কালনার দু’টি ব্লক মিলিয়ে ইটভাটার সংখ্যা ২৫টি। পলিমাটিতে তৈরি এই ইটের চাহিদা রয়েছে যথেষ্ট। প্রতি বছর এই ভাটাগুলিতে কাজ করতে ভিন্ জেলা, এমনকী ভিন্ রাজ্য থেকে বহু শ্রমিক আসেন। প্রতি ভাটায় গড়ে দু’শো জন করে শ্রমিক রয়েছেন। মাটি থেকে কাঁচা ইট তৈরি, সেগুলি কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যাওয়া ও ইট পোড়ানো— তিন ধরনের কাজের শ্রমিক রয়েছেন। উৎপাদন অনুসারে বেতন পান তাঁরা। মরসুম শেষে থোক টাকা নিয়ে বাড়ি ফেরেন। এ ছাড়া দৈনন্দিন খরচের জন্য মালিক বেতনের একটি অংশ প্রতি সপ্তাহে হাতে দেন, যা ‘হপ্তা’ বলা হয়।
ইটভাটার মালিকেরা জানান, এ বার সময় মতো কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু নোট বাতিলের পরে সব ভেস্তে গিয়েছে। কারণ, ইটের ক্রেতা মিলছে না। রাশি রাশি ইট পড়ে রয়েছে। তাই নতুন ইট তৈরি করে আর লাভ নেই। এ দিকে, একটি ইটভাটায় শ্রমিকদের হপ্তা বাবদই দরকার হয় প্রায় ৭০ হাজার নগদ টাকা। কিন্তু এখন ব্যাঙ্ক থেকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা তোলা যাচ্ছে। তা-ও সব সময় মিলছে না। শ্রমিকদের প্রায় কারও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। তাই নগদে টাকা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এই অবস্থায় ভাটা চালু রাখা মুশকিল
হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘কালনা ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সুশীল মিশ্র জানান, এক-একটি ভাটায় দিনে ৩০-৩৫ হাজার ইট তৈরি হয়। এখন দৈনিক বিক্রি হাজার পাঁচেক। ফলে, বিপুল ইট জমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘‘যা পরিস্থিতি তাতে ভাটাগুলি বন্ধের নোটিস ঝুলিয়ে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’’ এক ইটভাটার মালিক সুনীল কুমার বলেন, ‘‘আমাদের ইট তৈরির পরে দ্রুত বিক্রি হয়ে যায়। কিন্তু এখন পরিস্থিতি পুরো উল্টে গিয়েছে। বর্ষা নামার আগে শ্রমিকেরা পুরো মজুরির টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরে যায়। এ বার কী ভাবে টাকা জোগাড় হবে জানি না!’’
আতঙ্কে রয়েছেন শ্রমিকেরা। ঝাড়খণ্ড থেকে একটি ভাটায় কাজ করতে আসা উমা সর্দার, প্রশান্ত সর্দাররা জানান, নোট বাতিলের পর থেকে দু’সপ্তাহে এক বার করে হপ্তার টাকা মিলেছে। তাতে খরচ চালানো মুশকিল হচ্ছে। তাঁরা বলেন, ‘‘এখনও মালিক চলে যেতে বলেননি, তাই রয়েছি। কিন্তু যা পরিস্থিতি তাতে কত দিন রাখা হবে জানি না।’’
আর এক ভাটা শ্রমিক ফুলমনি বেসরা বলেন, ‘‘আর কোনও কাজ জানি না। এই কাজ করে যা পাই তা দিয়ে সারা বছর চলে। এখন ফিরে যেতে হলে খুব সমস্যায় পড়ব।’’
বেঙ্গল ব্রিকফিল্ড অ্যাসোসিয়েশনের এগজিকিউটিভ কমিটির সদস্য কমল হাওলাদার জানান, সারা রাজ্যেই ইট ভাটার এক পরিস্থিতি। জানুয়ারি থেকে ব্যাঙ্কে পর্যাপ্ত টাকা না মিললে চূড়ান্ত সঙ্কট তৈরি হবে বলে তাঁর আশঙ্কা।