অধরা কাজল, সুর চড়ল কেষ্টর

নাম না করে তাঁরই খাসতালুকে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘ক্রিমিনাল’ বলে দেগেছিলেন খোদ দলের শীর্ষনেতা ফিরহাদ হাকিম। সেই নেতা তৃণমূলেরই কেউ নন বলে বারবার দাবি করেছেন দলের দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডল।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বর্ধমান শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৬:৩১
Share:

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কর্মী সম্মেলনে অনুব্রত। —নিজস্ব চিত্র

নাম না করে তাঁরই খাসতালুকে দাঁড়িয়ে তাঁকে ‘ক্রিমিনাল’ বলে দেগেছিলেন খোদ দলের শীর্ষনেতা ফিরহাদ হাকিম। সেই নেতা তৃণমূলেরই কেউ নন বলে বারবার দাবি করেছেন দলের দাপুটে নেতা অনুব্রত মণ্ডল। অথচ তার কয়েক মাসের মধ্যেই দলীয় কার্যালয়ে নানুরের পদহীন তৃণমূল নেতা কাজল শেখের মাথায় হাত রাখতে দেখা যায় সেই অনুব্রতকেই! যদিও বিধানসভা ভোট আসতেই পাল্টে গিয়েছিল ছবিটা। কাজলের বিরোধিতায় বারবার তোপ দেগেছিলেন অনুব্রতরা।

Advertisement

নানুরে ঘনিষ্ঠ অনুগামী গদাধর হাজরার হারের ক্ষত নিয়ে এ বার সেই কাজলকেই গ্রেফতারের দাবি তুললেন অনুব্রত। শনিবার দুপুরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে তৃণমূল প্রভাবিত ‘সারা বাংলা শিক্ষাবন্ধু সমিতি’র সম্মেলনে এসে অনুব্রত বলেন, “কাজল শেখকে পুলিশ গ্রেফতার করুক। আমরা পুলিশের কাছে এই দাবি করেছি।”

ঘটনা হল, বীরভূমের রাজনীতিতে ২০১১-’১২ সাল পর্যন্ত কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ সাহানেওয়াজের ভাই কাজলের সঙ্গে ‘মধুর’ সম্পর্ক ছিল অনুব্রতর। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েতের ভোটের সময় থেকে ‘তিক্ততা’ শুরু হয়। এলাকার দখল এবং পঞ্চায়েতের নানা কাজের ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। অনুব্রত-কাজল বিবাদের জেরেই গত পঞ্চায়েত ভোটে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নানুর এলাকার সমস্ত আসনে জেতা তৃণমূল হেরে যায় জেলা পরিষদের আসনে। অতীতে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে খুনোখুনি, মারপিট, পরস্পরের কার্যালয় ভাঙচুর থেকে বোমাবাজি— সব ধরনের অভিযোগই উঠেছে। এরই মধ্যে কাজল-ঘনিষ্ঠ নানুরের তৎকালীন বিধায়ক গদাধর হাজরাও অনুব্রতর দিকে চলে আসেন। তার পরেও পঞ্চায়েত সমিতি এবং ১১টি পঞ্চায়েতের অধিকাংশই বর্তমানে কাজলের নিয়ন্ত্রণে। তার প্রমাণ মিলেছে গত বিধানসভা ভোটেই। ভোটের প্রচারে গদাধরকে ‘মুখ্যমন্ত্রীর প্রার্থী’ বলে প্রচার চালিয়েও জিততে পারেননি অনুব্রত। ওই আসনটি সিপিএমের দখলে আসার নেপথ্যে কাজলেরই কলকাঠি ছিল বলে মনে করে অনুব্রত গোষ্ঠী। দু’দিন আগে কেতুগ্রামে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে গণ্ডগোল এবং কেতুগ্রাম ১ পঞ্চায়েত সমিতির তৃণমূল সভাপতি জাহির শেখের স্ত্রীর গ্রেফতারির নেপথ্যেও কাজল-অনুব্রত গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বই দেখছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।

Advertisement

তৃণমূল সূত্রের খবর, নানুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে বিধানসভা ভোটের আগে গত সেপ্টেম্বরে দলের বীরভূম জেলার পর্যবেক্ষক ফিরহাদ হাকিম নানুরের ওই দুই নেতাকে নিয়ে মীমাংসা-বৈঠকও করেছিলেন। কিন্তু তার কয়েক দিনের মধ্যেই কাজলের উপরে হামলা চালানোর অভিযোগ ওঠে অনুব্রত অনুগামী গদাধর গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। তার পরেই গত ২৮ সেপ্টেম্বর বোলপুর-পালিতপুর সড়কের উপর নিমতলা এলাকায় অ্যাম্বুল্যান্স থেকে গুলি করে গদাধর অনুগামী তিন জন তৃণমূল কর্মীকে খুন করা হয়। ঘটনায় কাজল-সহ ২২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ হয়। কয়েক জনকে ধরা পড়লেও পুলিশের খাতায় তখন থেকেই অধরা কাজল।

কাজলকে গ্রেফতারের দাবি অবশ্য অনুব্রত এই প্রথম করছেন এমনটা নয়। গত বছর ১৯ মে নানুরের একটি জনসভায় দাঁড়িয়ে কাজলের নাম না করে অনুব্রত বলেছিলেন, ‘‘দলে যার কোন পদ-ই নেই, তাকে বহিস্কার করব কী করে! পুলিশ-প্রশাসন যেন কোনও তোলাবাজ, বন্দুকবাজ, বাইক বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছুপা না হয়।” ওই সভাতেই প্রায় এক সুর ছিল ফিরহাদের গলাতেও। তিনি বলেছিলেন, ‘‘এক জন ক্রিমিনালের আমাদের দলে জায়গা নেই। আমাদের মুখ্যমন্ত্রী পুলিশ-প্রশাসনকে কড়া ভাবেই তার মোকাবেলা করতে বলেছেন। সে জন্য আরাবুল জেলে গিয়েছেন। জেলে গিয়েছেন আমাদের অনেক নেতাও।’’ এমন লোকেদের (কাজল) পুলিশ-প্রশাসনকে কড়া হাতে দমন করতে হবে বলেই সে দিন হুঁশয়ারি দিয়েছিলেন অনুব্রতরা। যদিও সভার পরে, এমনকী নিমতলা হত্যা-কাণ্ডের পরেও পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি কাজলকে।

সেই কাজলের বিরুদ্ধেই অনুব্রতকে ফের সুর চড়াতে দেখা জল্পনা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মধ্যে। দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পরেই দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন, যে আসনে দল হেরেছে দলীয় স্তরে তার তদন্ত করা হবে। নানুরে হারের ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই অন্তর্ঘাতকেই দায়ী করেছে জেলা তৃণমূল। আর সেই অন্তর্ঘাতের পিছনে কাজলেরই হাত দেখেছে অনুব্রত-গোষ্ঠী। কারণ, বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই নানুরের তৃণমূল প্রার্থী গদাধর হাজরার বিরোধিতা করছিলেন কাজল। এমনকী, ভোটের দিনেও তৃণমূল দুপুর পর্যন্ত প্রায় ৫০টি বুথে এজেন্ট দিতে পারেনি। পরে মমতার হস্তক্ষেপে এজেন্ট বসায় তৃণমূল। তৃণমূল সূত্রের খবর, ফের ক্ষমতায় আসার পরে এলাকা পুনর্দখলে এ বার কাজলের গ্রেফতারিকেই হাতিয়ার করতে চাইছেন অনুব্রত। অনুব্রত গোষ্ঠীর এক নেতার কথায়, “নানুরের মাটিতে কাজল থাকলে গদাধরের ‘এন্ট্রি’ নেওয়া কঠিন। সে কারণেই কেষ্টদা সম্ভবত প্রকাশ্যে কাজলকে গ্রেফতার করা দরকার বলে মন্তব্য করেছেন।”

যদিও কাজলের ‘সাহায্য’ ছাড়া নানুর পুনরুদ্ধার কত দূর সম্ভব, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তৃণমূলেরই অন্দরে। দলের সেই অংশটি অবশ্য মনে করছে, কেষ্টদা যতই বাইরে কাজলের বিরুদ্ধে চাপ বাড়ান, অদূর ভবিষ্যতে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে ফের সন্ধি হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। অন্য দিকে, বিধানসভা ভোটের ফলে নানুরে তাঁর দাপট দেখালেও নিমতলা-কাণ্ডের পর থেকেই চাপে রয়েছেন কাজল নিজেও। প্রায় আট মাসের বেশি সময় ধরে তিনি ঘরছাড়া। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্রের দাবি, রাজনীতি করতে গিয়ে নিমতলা-সহ একাধিক মিথ্যা মামলায় কাজলকে ফাঁসানো হয়েছে। ফোন বন্ধ থাকায় এ দিন কাজলের সঙ্গে অবশ্য যোগাযোগ করা যায়নি। অনুব্রতর দাবি নিয়ে নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি কাজলের দাদা সাহানেওয়াজও।

পুলিশের দাবি, কাজলের নামে একাধিক অভিযোগ থাকলেও নিমতলা হত্যা-কাণ্ড ছাড়া সব মামলাতেই তিনি জামিনে রয়েছেন। বিধানসভা ভোটের আগে থেকেই কাজল এলাকা ছাড়া। তাঁর খোঁজে একাধিকবার তল্লাশি চালানো হয়েছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন