বর্ধমান মেডিক্যালে ডাক্তার নিগ্রহ এ বার থামুক

৬ জুন রাধারানি ওয়ার্ডে কীটনাশক খেয়ে ভর্তি হওয়া বাবুরবাগের দম্পতির চিকিৎসায় গাফিলতির নালিশে জুনিয়র ডাক্তারদের মারধর করা হয়। রুখতে গিয়ে মার খান নিরাপত্তারক্ষীরা, পুলিশ।

Advertisement

অনিন্দ্য মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৮ ১৩:২৬
Share:

নিগ্রহের পরে অসুস্থ চিকিৎসক। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে। ফাইল চিত্র

গত এক মাসের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তারেরা যেন মন্দিরের ঘণ্টা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। যার, যখন ইচ্ছে বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য-কর্তারা ছাড়া, প্রতিবাদ করার কেউ নেই। জনতা জানছে, কিন্তু প্রতিক্রিয়া নেই। কিন্তু এক বারও কেউ ভেবে দেখছেন না বর্ধমান মেডিক্যালের ডাক্তারেরা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন কি না বা তাঁরা সে অভাব বোধ করে পরিষেবা দেওয়া থেকে সাময়িক সরে আসার কথা ভাবলে, কী হতে পারে।

Advertisement

৬ জুন রাধারানি ওয়ার্ডে কীটনাশক খেয়ে ভর্তি হওয়া বাবুরবাগের দম্পতির চিকিৎসায় গাফিলতির নালিশে জুনিয়র ডাক্তারদের মারধর করা হয়। রুখতে গিয়ে মার খান নিরাপত্তারক্ষীরা, পুলিশ। ১১ জুন অস্থি ওয়ার্ডের এক রোগীর পরিজনদের সরতে বলায় এক প্রবীণ চিকিৎসককে মারধর করা হয়। তাঁকে বাঁচাতে প্রহৃত হন চার ডাক্তার। প্রহৃত চিকিৎসক কৃষ্ণকমল দে-র প্রশ্ন ছিল, “রোগীর চিকিৎসার স্বার্থে শুধু ওয়ার্ডের রাস্তা থেকে সরে যাওয়ার কথা বলায় গায়ে হাত তোলা হবে? এটা ভাবা যায়!”

ভাবা কঠিন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তেমনটাই ঘটছে। ১৬ জুন কীটনাশক পান করে হাসপাতালের রাধারানি ওয়ার্ডে ভর্তি হয়েছিলেন তরুণী। পরিবারের দাবি ছিল, তাঁকে আইসিইউয়ে (ইন্টেন্সিভ কেয়ার ইউনিট) ভর্তি করাতে হবে। ডাক্তারেরা প্রয়োজন নেই জানাতেই শুরু ঝামেলা। দুই জুনিয়র ডাক্তারকে মারধরের অভিযোগ ওঠে রোগীর পরিজনেদের বিরুদ্ধে। তাঁরা অবশ্য দাবি করেন, ভর্তির পর থেকে রোগিণীকে ফেলে রাখা হয়েছিল। প্রতিবাদ করায় নিরাপত্তা রক্ষীরা তাঁদেরই মারে। যদিও ওই ওয়ার্ডের অন্য রোগীদের একটা বড় অংশের দাবি ছিল, মেয়েটির আত্মীয়েরা প্রথম থেকেই আইসিইউয়ে ভর্তির জন্য চিৎকার করছিলেন। ডাক্তারেরা ‘এখানেই চিকিৎসা হবে’ বলায় বচসা হয়। তার পরেই দু’জন ডাক্তারদের উপরে চড়াও হয়।

Advertisement

শেষ দু’টি হামলার ঘটনা থেকে ভেবে নেওয়া যেতেই পারে, কোথায় যেন ডাক্তারের উপরে রোগী বা তাঁর পরিবারের ভরসার জায়গাটি নষ্ট হচ্ছে। ডাক্তারের ডাক্তারি পড়াশোনা বা পরামর্শকে নজরআন্দাজ করার প্রবণতাও স্পষ্ট।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিষেবা এবং পরিকাঠামোগত সমস্যা নানা সময়ে সংবাদ শিরোনামে এসেছে। এই হাসপাতালের ডাক্তারদের ভূমিকাও প্রশ্নের উর্ধ্বে ছিল না। ২০১২
সালের ২৮ মার্চ ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃ়ত্যুর অভিযোগ নিয়ে গলসির কিছু বাসিন্দার সঙ্গে গোলমালে জড়িয়ে পড়েছিলেন হাসপাতালের জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশ। গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলিয়ে রোগীর পরিজনদের মারধরের অভিযোগ ওঠে কিছু জুনিয়র ডাক্তারের বিরুদ্ধে। এমনকি, ঘটনার ছবি তুলতে গেলে তাঁদের ‘হামলায়’ কয়েক জন সাংবাদিক ও চিত্রগ্রাহক আহত হন বলেও অভিযোগ ছিল। কিন্তু সে সব অভিযোগের নিষ্পত্তির জন্য আইন-আদালত রয়েছে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, পূর্ব এবং পশ্চিম বর্ধমানের বিস্তীর্ণ অংশ এবং লাগোয়া বীরভূমের অনেকে সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা পেতে বর্ধমান মেডিক্যালের উপরে নির্ভর করেন। ফলে, ডাক্তারদের উপরে চাপ আছে। ডাক্তারেরা মানুষ এবং মানুষের ভুল হতে পারে। ডাক্তারদের যদি সে ছাড়টুকুও দেওয়া না হয় এবং সরকারি চিকিৎসা পরিষেবাকে আর পাঁচটা পণ্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার প্রবণতাই পেয়ে বসে—তা হলে বিপদ বাড়বে। কমবে না।

সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারের অভাব নিয়ে প্রায়শই আক্ষেপ করতে শোনা যায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। সেখানে পর পর এ ধরনের ঘটনা ডাক্তারদের নবীন প্রজন্মকে নিরাপত্তার অভাবে ভোগাতে পারে। সদ্য পাশ করা চিকিৎসককে সরকারি হাসপাতালে চাকরি করায় বা নেওয়ায় বিমুখ করেও তুলতে পারে। ডাক্তারদের ধৈর্যচ্যুতিতে কী হতে পারে? হাসপাতালের ডেপুটি সুপার অমিতাভ সাহার কথায়, ‘‘পরিষেবা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়বে।’’ বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের মতো বড় হাসপাতাল কোনও এক দিন চিকিৎসা পরিষেবা বন্ধ করে দিলে জনতার ঠিক কতটা হয়রানি হতে পারে, ভাবা কি খুব কঠিন?

অথচ, হাসপাতালটিকে নিছক যেমনতেমন করে পরিষেবা দেওয়ার জায়গা হিসেবে ভাবা যাচ্ছে না। গত ছ’মাস ধরে এই বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, কর্মীরাই আগলে রেখেছেন ‘এইচআইভি পজিটিভ’ এক কিশোরকে। অনাথ ওই কিশোরের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁরা জানাচ্ছেন, হাত ধরলে, কথা বললে যে এ রোগ ছড়ায় না এটাই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। এই চেষ্টা যেখানে রয়েছে, সেখানে সংবেদনশীলতা বা মানবিকতায় ঘাটতি রয়েছে বলে এক কথায় দেগে দেওয়া যায় না।

তা হলে কোথায় বদল দরকার? সরকারি হাসপাতালে মেলা চিকিৎসা পরিষেবা নিয়ে প্রশ্ন তোলার পদ্ধতিতে। সব ডাক্তার অবিতর্কিত নন। তাঁদের ব্যবহার, মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু তা জানানোর পদ্ধতি রয়েছে। অভিযোগ লিখে জমা দেওয়া যেতে পারে হাসপাতালের ‘ড্রপ-বক্স’-এ। সরাসরি দেখা করা যেতে পারে হাসপাতালের সুপার, অধ্যক্ষ, ডেপুটি সুপার, অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার পদমর্যাদার ডাক্তারদের সঙ্গে। তাঁদের কাছে অভিযোগ জানিয়েও সুরাহা হয়নি, এমন মনে হলে দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে স্বাস্থ্য ভবনের।

চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে চালু হয়েছে আর একটি ব্যবস্থা। সরকারি হাসপাতালে গিয়ে হেনস্থার শিকার হলে বা সেখানকার পরিষেবা-পরিকাঠামো নিয়ে অভিযোগ থাকলে তা সরাসরি ফোন করে স্বাস্থ্য ভবনের নতুন অভিযোগ-সেলে জানাতে পারবেন সাধারণ মানুষ। এ জন্য একটি হেল্পলাইন নম্বর দেওয়া হয়েছে। তা হল— ১০৪। যে বা যাঁরা অভিযোগ জানিয়ে ফোন করবেন, তাঁদের ‘গ্রিভান্স আইডি নম্বর’ দেওয়া হবে। পরে স্বাস্থ্য দফতরের ওয়েবসাইটে ‘গ্রিভান্স’-এর জায়গায় ‘ক্লিক’ করে ওই নম্বর অনুযায়ী অভিযোগকারী জানতে পারবেন, তাঁর অভিযোগের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জেলার নতুন স্বাস্থ্য কমিশনার হলেন জেলাশাসক। তেমন দরকার হলে তাঁর শরণও নেওয়া যেতে পারে।

অভিযোগ শোনার ব্যবস্থা যেখানে মজুত, সেখানে তাৎক্ষণিক ক্ষোভের যুক্তিতে আইন হাতে তুলে নেওয়া কোনও ভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা দেবাশিস ভট্টাচার্য সাধে বলেছেন, ‘‘সমাজ বদলাতে সমাজের লোকজনকেই এগিয়ে আসতে হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন