রাতের দুর্গাপুরে বাস পাওয়া যেন লটারি, বলছেন ভুক্তভোগী

পোষালে চলুন, বলে দেয় অটো

সিটি সেন্টারের মাল্টিপ্লেক্সে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে এসেছিলেন এ-জোনের বাসিন্দা কলেজছাত্রী দেবযানী রায়। রাত সাড়ে ৯টায় সিনেমা শেষে বাসস্ট্যান্ডে এসে শুনলেন শেষ বাস বেরিয়ে গিয়েছে। অটো রিজার্ভ করে বাড়ি ফিরতে হল তাঁদের। প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে।

Advertisement

সুব্রত সীট

দুর্গাপুর শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৭ ০০:৪১
Share:

অপেক্ষা: কখন গাড়ি মিলবে তার জন্য দাঁড়িয়ে রাতের যাত্রীরা। দুর্গাপুর স্টেশনে। ছবি: বিশ্বনাথ মশান

রাত ১০ টা বেজে ৫ মিনিট। কলকাতায় ব্যবসার কাজকর্ম সেরে ইলাহাবাদগামী বিভূতি এক্সপ্রেসে এসে দুর্গাপুর স্টেশনে নামলেন ডিএসপি টাউনশিপের বি-জোনের বাসিন্দা সম্রাট বণিক। এসে দেখলেন, রুটের শেষ মিনিবাস বেরিয়ে গিয়েছে প্রায় এক ঘণ্টা আগেই। কী আর করা! চড়া ভাড়ায় ট্যাক্সি রিজার্ভ করে বাড়ি ফিরলেন তিনি।

Advertisement

সিটি সেন্টারের মাল্টিপ্লেক্সে বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে এসেছিলেন এ-জোনের বাসিন্দা কলেজছাত্রী দেবযানী রায়। রাত সাড়ে ৯টায় সিনেমা শেষে বাসস্ট্যান্ডে এসে শুনলেন শেষ বাস বেরিয়ে গিয়েছে। অটো রিজার্ভ করে বাড়ি ফিরতে হল তাঁদের। প্রায় দ্বিগুণ ভাড়া দিয়ে।

রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে দুর্গাপুর পুরসভাতেও। কিন্তু, শপিং মল, মাল্টিপ্লেক্স, তারকা হোটেল, আইটি হাব, এডুকেশন হাব-এ সমৃদ্ধ দুর্গাপুর শহরের গণ পরিবহন ব্যবস্থার ভোল বদলায়নি এতটুকুও। অটোর বাঁধনছাড়া ভাড়া আর রাতে বাসের আকাল— দুইয়ে মিলে আজও জেরবার দুর্গাপুরবাসী। রাত ৮ টার পর থেকেই একে একে রাস্তা থেকে উধাও হতে থাকে মিনিবাস, রুটের অটো। নিজের গাড়ি বা বাইক থাকলে আলাদা কথা। নতুবা চড়া ভাড়া গুণে অটো রিজার্ভ করাই একমাত্র উপায় রাতের দুর্গাপুরের যাতায়াতে।

Advertisement

অথচ এ বছরই জুন মাসে দুর্গাপুরে এসে পরিবহণ মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী এই সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছিলেন। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, অবস্থা কিন্তু এখনও বদলায়নি।

দুর্গাপুর স্টেশন থেকে ছেড়ে এক এক রুটের মিনিবাস শহরের এক এক দিক দিয়ে বেনাচিতির প্রান্তিকা বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গিয়েছে, মায়াবাজার এবং এমএএমসি রুটের শেষ বাস স্টেশন থেকে পৌনে ৯টা নাগাদ ছাড়ে। এ-জোন, বি-জোন রুটের শেষ বাস রাত সওয়া ৯টায়। একমাত্র ভিড়িঙ্গি রুটের শেষ বাস ছাড়ে রাত সাড়ে ১০টায়। কিন্তু, সে বাস সিটি সেন্টার বাসস্ট্যান্ড থেকে জাতীয় সড়ক ধরে বেনাচিতি চলে যায়। ফলে কবিগুরু, নন-কোম্পানি, সেপকো, ডিএসপি টাউনশিপ প্রভৃতি এলাকায় যাওয়া যায় না। শহরের প্রাণকেন্দ্র সিটি সেন্টারে নানা প্রয়োজনে সন্ধ্যার দিকে মানুষজন আসেন। নিজস্ব যানবাহন যাঁদের নেই, তাঁদের চোখ ঘন ঘন চলে যায় ঘড়ির কাঁটার দিকে। এই বুঝি শেষ বাস বেরিয়ে গেল!

পরিবহণ সমস্যার শুরু মূলত নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে। আধুনিকীকরণের হাত ধরে দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্ট ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। রাজ্য সরকারের নতুন শিল্পনীতির কারণে শিল্প-কারখানায় এবং ব্যবসা ক্ষেত্রে নতুন নতুন বিনিয়োগ আসতে শুরু করে। কর্মসূত্রে বাইরে থেকে হাজার হাজার মানুষ শহরে আসেন। ভিন্ রাজ্য থেকে পড়ুয়াদের ঢল নামে শহরের নানা বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তাঁদের অনেকেই কাজের শেষে বা পড়াশোনা সেরে সিটি সেন্টারে ঘুরতে আসেন। পছন্দের রেস্তোঁরায় রাতের খাবার খান। কিন্তু, একটু রাত হলেই ফেরার বাস মেলে না।

২০০৮ সালে চালু হয় সিএনজি অটো পরিষেবা। অভিযোগ মিনিবাসের মতো রাত বাড়তেই উধাও হয়ে যায় রুটের অটোও। অথচ বেশি ভাড়া দিয়ে ‘রিজার্ভ’ করতে চাইলে অটোর লাইন লেগে যায়! ভাড়া শুনে চোখ কপালে ওঠে যাত্রীদের। স্টেশন থেকে ৫৪ ফুট যেতে অটো রিজার্ভ ভাড়া হল ১২০ টাকা। অথচ দিনের বেলায় সেই রুটেই শেয়ারে দু’টি অটোতে লাগে মাত্র ২০ টাকা! একই ভাবে সিটি সেন্টার থেকে চণ্ডীদাস বাজারে অটো ভাড়া দিনে ১০ টাকা। রাত ৮টার পরে শেয়ার অটো থাকে না বললেই চলে। চণ্ডীদাস এলাকার বাসিন্দা বিনয় পালের ক্ষোভ, ‘‘সিটি সেন্টারে রাতের কাজ সেরে বাড়ি ফেরাটা আতঙ্কের। বাস পাওয়া তো লটারি মেলার সামিল! অটোচালককে কিছু বলাই যায় না। দরাদরি করতে গেলে জোটে দুর্ব্যবহার। বলে দেওয়া হয়, পোষালে চলুন, না হলে কাটুন। রিজার্ভে আট-দশ গুণ বেশি ভাড়া পড়ে।’’

মিনিবাস মালিকদের একটি সংগঠনের সম্পাদক কাজল দে অবশ্য দাবি করেন, ‘‘রাত ৯টার পরে শহরে যাত্রী পাওয়াই দুষ্কর। এ দিকে জ্বালানি ও যন্ত্রাংশের দাম বেড়েই চলেছে। ওই সময় বাস চালানো লোকসান ছাড়া কিছু নয়।’’ অটো চালকদেরও একই বক্তব্য। সন্ধ্যার পর থেকে নাকি শেয়ারের যাত্রী পাওয়া কঠিন। তাই রিজার্ভ পদ্ধতি। রেলের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় জায়গা না মেলায় শহরে চালু হয়নি প্রি-পেড মিটার ট্যাক্সিও। দক্ষিণবঙ্গ রাজ্য পরিবহণ সংস্থার পক্ষ থেকে এক সময় রাতের দিকে ২৮ আসনের সিটি বাস চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তা-ও বাস্তবায়িত হয়নি। ‘সিটি সার্ভিস’ চালুর করার আশু পরিকল্পনা নেই বলে জানিয়েছেন সংস্থার এক কর্তা।

দুর্গাপুরের মেয়র দিলীপ অগস্তি জানিয়েছেন, এক সময় রাতের দিকে একটি সরকারি বাস স্টেশন থেকে সারা শহর ঘুরে বেনাচিতির প্রান্তিকা পর্যন্ত যেত। তেমন ব্যবস্থা ফের চালু করা যায় কি না কিংবা অটোগুলি রাতে আরও কিছুক্ষণ যাতে রুটে চলে, এ সব বিষয় নিয়ে মহকুমাশাসক ও দক্ষিণবঙ্গ পরিবহণ সংস্থার সঙ্গে কথা বলা হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন