—প্রতীকী চিত্র।
কেন্দ্রের ‘জল জীবন মিশন’ (জেজেএম) বনাম রাজ্যের ‘জলস্বপ্ন’। লোকসভা ভোট এগিয়ে আসতেই নিখরচায় বাড়ি বাড়ি পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করে তরজায় জড়িয়েছে বিজেপি ও তৃণমূল। কিন্তু, বহু এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, পর্যাপ্ত জল পাওয়া সেই স্বপ্নই থেকে গিয়েছে।
গলসির খেতুড়া গ্রামের ইসরা বেগম থেকে মেমারির বাহাবপুরের শান্তা মুর্মুর বক্তব্য, জলের সংযোগ থাকলেও কলে জল আসে না। এলেও জল পড়ে সরু সুতোর মতো। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত মেরে-কেটে ১০ লিটারের বালতিও ভরে না রায়নার সীমা সামন্তর বাড়ির কলে। জেলার অনেক এলাকাতে এমনই অবস্থা সরকারি জল প্রকল্পের।
কেন্দ্রের ‘জেজেএম’ বা রাজ্য সরকারের ‘জলস্বপ্ন’ প্রকল্প থেকে গত কয়েক বছর ধরে বাড়ি বাড়ি পানীয় জলের সংযোগ দিচ্ছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। জেলার কম-বেশি সব গ্রামের বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, হাঁটুর সমান উচ্চতার একটি কল বসেছিল বাড়িতে। কিন্তু জলের যা চাপ, তাতে দিনে ৩০ লিটার জলও পাওয়া যায় না। মেমারির শ্রীধরপুর গ্রামের কয়েকজন মহিলার দাবি, গরম পড়তেই রাস্তার কলের সামনে লাইন ক্রমশ লম্বা হচ্ছে। জলের জন্য চুলোচুলিও শুরু হয়েছে। গ্রামে প্রায় দু’বছর আগে বাড়ি বাড়ি কল তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জল এখনও আসেনি।
জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর সূত্রে জানা যায়, জেলার গ্রামীণ এলাকায় ১১ লক্ষ ২৪ হাজার ২০৪টি বাড়িতে জলের সংযোগ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধার্য হয়েছিল। ২০২৪-র মার্চের মধ্যেই সব বাড়িতেই সংযোগ দেওয়ার কথা ছিল। যদিও নতুন আর্থিক বছরে সব বাড়িতে সংযোগ দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্ট বিভাগ। গত সপ্তাহের শেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, জেলায় ৬,৭৮,৩৭৮টি বাড়িতে দলের সংযোগ দেওয়া হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার ৬০.১৭%। এই প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগেও জেলার বিভিন্ন গ্রামে সরকারি প্রকল্পে জল সরবরাহ হত। সে সব প্রকল্পগুলির অধিকাংশ মুখ থুবড়ে পড়েছে।
গলসির খেতুড়ে রাস্তায় পানীয় জলের কল থাকলেও ১০ বছর ধরে জল পড়ে না। স্থানীয়দের দাবি, রাস্তা করতে গিয়ে পাইপ লাইন ফেটে গিয়েছিল। সেই থেকে আর জল মেলে না। একই ছবি ইড়কোনা, ভারিচা গ্রামেরও। পাইপ লাইন থাকলেও পাঁচ বছর ধরে জল আসে না বলে অভিযোগ। একাধিক উপভোক্তার দাবি, “কল দিয়ে জল পড়ার ছবি তুলে নিয়ে গিয়েছে ঠিকাদার সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ। আধার কার্ডও নিয়েছে। দ্বিতীয় দিন থেকে সুতোর মতো জল পড়ছিল। ধীরে ধীরে জল পড়া বন্ধ হয়ে যায়। জলই যখন পাওয়া যাবে না, তখন কল দিয়ে পরিহাস করার কোনও মানে হয়?”
অগত্যা পানীয় জলের জন্য গ্রামীণ জনতাকে নির্ভর করতে হচ্ছে টিউবওয়েলের উপরে। বেশির ভাগ সময়ই যে জল তাতে ওঠে, তা অস্বাস্থ্যকর বলে দাবি। আর বাড়ির কাজের জন্য ভরসা পুকুরের ঘোলা জল। জামালপুরের নবগ্রামের মহিলারা জানাচ্ছেন, গরম বাড়লে আর টিউবওয়েলের সামনে লাইন আরও লম্বা হলে রান্নাও হবে পুকুরের জলে। দিনে ছ-সাত বার টিউবওয়েল থেকে জল সংগ্রহ করেন মহিলারা।
প্রশাসন সূত্রের খবর, কেতুগ্রাম, মঙ্গলকোট, কাটোয়া ১, খণ্ডঘোষ, গলসি ১, কালনা ২ ব্লকের মতো অনেক জায়গায় লক্ষ্যমাত্রার ৫০% পানীয় জলের সংযোগও দেওয়া যায়নি। জেলায় ২১৬৮টি গ্রামের মধ্যে ৯৬২টিতে জলের লাইন রয়েছে। ৬০৮টি গ্রামে জলের লাইন বসানো হচ্ছে। পাইপ বসানোর জন্য বর্ধমান শহর লাগোয়া সরাইটিকর পঞ্চায়েতে অনেক জায়গায় রাস্তায় গর্ত করা হয়েছিল। কিন্তু তা এখনও সংস্কার করা হয়নি বলে অভিযোগ।
বিজেপির বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের মুখপাত্র সৌম্যরাজ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, “পানীয় জলের জন্য কেন্দ্রের সরকার দেদার টাকা দিয়েছে রাজ্য সরকারকে। সেই টাকাতেই বাড়ি বাড়ি পানীয় জলের সংযোগ দেওয়ার কথা। কিন্তু তৃণমূল সরকার এতই অপদার্থ যে, কল দিলেও জল দিতে পারছে না। অনেক বাড়িতে কলও দিতে পারেনি।” তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র প্রসেনজিৎ দাসের পাল্টা, “মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগেই বাড়ি বাড়ি জল দিচ্ছে সরকার। সম্পূর্ণ নতুন পরিকাঠামো গড়ে জল দেওয়া হচ্ছে। সে কারণে কিছুটা সময় লাগছে।”